অন্যের জমি দখল করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেবার অভিযোগ উঠেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি সদ্য গ্রেফতার হওয়া বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বিরুদ্ধে। রাজধানীর বারিধারায় দুস্থ সাংবাদিকদের নামে ওয়াকফ করা ৫ একর জমি দখল করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেবার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড
ওয়েলফেয়ার (জার) নামে একটি সংস্থাকে ঢাকার বারিধারায় বরাদ্দ দেয়া ১০ একর
জমির মধ্যে ৫ একর জমি দখলে নেন বিচারপতি মানিক।
নথিপত্র অনুযায়ী, ১৮৮৫ সাল থেকে আইন উদ্দিন হায়দার ও ফয়জুন্নেছা ওয়াকফ
এস্টেটের মালিকানাধীন হলেও ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি
দেখান মানিক। এছাড়াও ‘অ্যাডভান্স ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি কোম্পানিকে দিয়ে
সেখানে তৈরি করেন ৮ তলাবিশিষ্ট সাতটি ভবন। সব মিলিয়ে তৈরি হয় শতাধিক
ফ্ল্যাট। এসব ফ্ল্যাট বিক্রি করে হাতিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। এসব ফ্ল্যাট
বিক্রির পাশাপাশি একটি বাড়িতে নিজে বসবাস করছিলেন। বারিধারা সাউথপয়েন্ট
স্কুলের পাশেই অবস্থিত তার ভবনের সামনে লেখা রয়েছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক), অ্যাডভান্স বারিধারা চৌধুরী ভবন।
ঠিকানা লেখা রয়েছে, রোড নম্বর-১১, ব্লক-জে।
বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে সমালোচিত হয়েছেন বারবার। বিচারপতির আসনে বসে যখন
যাকে খুশি আদালতে ডেকে অপমান-অপদস্থ করা, বিজনেস ক্লাসে বসতে না পেরে
বিমানের ভেতর তুলকালাম, রাস্তায় সালাম না দেওয়ায় ট্রাফিক পুলিশকে আদালতে
তলব, ২১ জন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে পদোন্নতি, সরকারি বাড়িতে থেকে ভাড়া না দেওয়া,
লন্ডনে বাড়ি কিনে আয়ের উৎস দেখাতে না পারা এবং সর্বশেষ টকশোতে গিয়ে
উপস্থাপিকার সঙ্গে অশোভন আচরণসহ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন এ এইচ এম
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এখানেই শেষ নয়, দখলবাজিতেও পিছিয়ে ছিলেন না সাবেক
এই বিচারপতি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রতিবেশী দেশে পালাতে গিয়ে গত ২৩ আগস্ট রাতে
সিলেট সীমান্তে স্থানীয় বাসিন্দা ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) হাতে
ধরা পড়ে এখন কারাবন্দি হন সাবেক এই বিচারপতি মানিক।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী
শামসুদ্দিন মানিককে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। পরে ২০০১
সালের ৩ জুলাই তাকে দুইবছরের জন্য হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে
নিয়োগ দেয়া হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সে নিয়োগ স্থায়ী করা
হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর শামসুদ্দিন চৌধুরী
মানিক বিচারপতি হিসেবে পুনর্বহাল হন। ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের
আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান মানিক। এ সময় হাইকোর্ট বিভাগের
জ্যেষ্ঠ ২১ জন বিচারককে ডিঙিয়ে তাকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৫ সালের
২ অক্টোবর অবসরে যান তিনি।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল
বিভাগ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান (মখা) আলমগীরের সংসদ সদস্য
খারিজ করলেও বিচারপতি মানিক হাইকোর্ট বিভাগে থাকাকালে আপিল বিভাগের ওই রায়
উপেক্ষা করে তথা লংঘণ করে মহিউদ্দিন খান (মখা) আলমগীরকে সংসদ সদস্য হিসেবে
বহাল রাখার ঘোষনা দেন। বিচারপতি মানিকের এই ঔদ্ধ্যত্ব জানার পর অজ্ঞাত
কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি তখনকার প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল
হক।
শুধুই এই একটি ঘটনা নয়, ফার্মগেইট এলাকায় রাস্তায় সালাম না দেয়ায় ২০০৩ সালে
ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ তোলেন
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তখনকার আইজিপি ওই ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ নিলে এই
ঘটনার জেরে তখনকার আইজিপি শহুদুল হুদা চাকরি হারান। বিচারপতি মানিক
হাইকোর্টে কর্নেল তাহের হত্যা মামলার বিচার করেন। তিনি নিজেই আদালত বসিয়ে
সাক্ষ্যগহণ করে রায় দেন। সে রায়ে মানিক কর্নেল তাহেরের বিচারকে ‘ঠান্ডা
মাথার খুন’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি জিয়াউর রহমানকে ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’
হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।
সড়ক ভবনের জমি নিয়ে বিরোধে ২০১২-তে জাতীয় সংসদের সঙ্গে বিতর্কে জড়ান
বিচারপতি মানিক। তৎকালীন সংসদের স্পিকার আব্দুল হামিদের (পরবর্তী সময়ে
রাষ্ট্রপতি) নজিরবিহীন সমালোচনা করেছিলেন। আব্দুল হামিদকে ‘বটতলার উকিল’
বলে সমালোচনা করেন। এরপর জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা
শামসুদ্দিন মানিকের সমালোচনা করেন।
সে সময় প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ শামসুদ্দিন
চৌধুরী মানিককে ‘স্যাডিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, ‘তিনি মানুষকে
অপমান করতে পছন্দ করেন। যারা স্যাডিস্ট, অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়, আমরা
তাদের ঘৃণা করি। তৎকালীন সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদে বলেছিলেন,
‘শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তার পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। এ ছাড়া শেখ
ফজলুল করিম সেলিম ও রাশেদ খান মেনন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সমালোচনা
করেছিলেন। তবে সংসদে এই সমালোচনার পরও তার কোনো অসুবিধা হয়নি। উল্টো ছয়
মাসের মাথায় আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে পদোন্নতি পান।
২০১২ সালের শেষ দিকে বিচারপতি থাকা অবস্থায় বিমানের বিজনেস ক্লাসে সিট না
পাওয়ায় লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছিলেন বিচারপতি মানিক। সেই ঘটনায় বিমান বাংলাদেশ
এয়ারলাইন্সের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশ জারি
করেছিলেন তিনি। পরে বিমানের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ চারজন ঊর্ধ্বতন
কর্মকর্তা হাইকোর্টে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চে গিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা
চেয়ে রেহাই পান।
এক মামলায় তিনি আওয়ামী লীগের সেসময়কার সাধারণ সম্পাদক (পরে প্রয়াত) আব্দুল
জলিলকে তলব করেছিলেন। সকালে তলব করা হলেও পরে বিকেলে সেই তলব আদেশ
প্রত্যাহার করেন। পরে তিনি তলবের আদেশের কথা অস্বীকার করেন। তিনি হাইকোর্টে
থাকালে যাকে তাকে তলব করে কাঠপড়ায় নিয়ে গালমন্দ করতেন।
২০১২ সালে শামসুদ্দিন মানিক লন্ডনে তিনটি বাড়ি ক্রয় করে তার আয়ের উৎস
দেখাতে পারেননি। এ ছাড়া লন্ডনে শামসুদ্দিন মানিক ও তার পরিবারের নামে আরও
সম্পত্তি আছে বলেও জানা গেছে। ২০১৫ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি থাকা
অবস্থায় শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার
সিনহার সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়ান।
একটি বেঞ্চ থেকে তাকে সরিয়ে দেয়ার জেরে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অভিশংসন চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন মানিক। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আত্মীয়দের সঙ্গে তখনকার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সাক্ষাতকারের অভিযোগ তুলেছিলেন বিচারপতি মানিক।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের
টকশোতে গিয়ে এক নারী উপস্থাপকের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে ফের সমালোচনার মুখে
পড়েন মানিক। যদিও পরে নিজেকে অসুস্থ দাবি করে সেই উপস্থাপিকার কাছে ক্ষমা
চেয়েছিলেন।
বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের বাংলাদেশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের
নাগরিকত্ব রয়েছে। সেখানে মানিকের একাধিক বাড়িও রয়েছে। ২০১২ সালে বিচারপতি
থাকা অবস্থায় লন্ডনে তিনি হামলার শিকার হয়েছিলেন। ২০১৫ সালের পর লন্ডনে
আরেকবার হামলার শিকার হন।
এ ছাড়া শামসুদ্দিন মানিকের বিরুদ্ধে সরকারি বাড়ি ভাড়া পরিশোধ না করা বিষয়ে
অনুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের
এক আইনজীবী। নোটিশে বলা হয়, অবসরে যাওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় রাজধানীর
গুলশানে একটি সরকারি বাড়ি দখলে রেখেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। পরে ২০১৭ সালে তিনি বাড়িটি
ছাড়লেও বাড়ি ভাড়া, গ্যাস ও পানি বিল বাবদ সরকারের পাওনা ১৪ লাখ ১৯ হাজার
২০০ টাকা এখনো পরিশোধ করেননি তিনি।
আ. দৈনিক / কাশেম