রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ভালো অবস্থানে ছিল অগ্রণী ব্যাংক। কিন্তু খেলাপি ঋণে জর্জরিত, সুশাসনের অভাবসহ নানা অনিয়মে জর্জরিত হয়ে পড়ে ব্যাংকটি। গত বছর ছাত্রজনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হয়ে এসেছেন সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। ব্যাংকিং খাতের অভিজ্ঞ এ কর্মকর্তা এক সময় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। অগ্রণী ব্যাংক নিয়ে নানা পরিকল্পনা, পাশাপাশি দেশের ব্যাংকিং খাত, মূল্যস্ফীতি, ডলার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেছেন সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। বিস্তারিত জানাচ্ছেন রমজান আলী-
প্রশ্ন: একটি সরকারি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। ব্যাংকিং খাতের সার্বিক চিত্র আপনার দৃষ্টিতে কেমন অবস্থানে আছে।
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: দেশের আর্থিক খাত গত ১৫ বছরে যে অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল আওয়ামীলীগ সরকার তা অকল্পনীয়। এর প্রভাবে ৫০ শতাংশ ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এর মধ্যে প্রায় ৩০ টি ব্যাংক ভালো নেই। লুটপাটের কারণে কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যে ব্যাংকগুলো কর্মীদের বেতন- ভাতা পর্যন্ত দিতে পারছে না। এমনকি আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। পরিবর্তীত সময়ে প্রকৃত চিত্র বের হওয়ায় বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আরো বাড়বে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হলো সেই ব্যাংকগুলো যা সরকারের মালিকানাধীন এবং পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) সহ মোট ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এই ব্যাংকগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হল সরকারের বিভিন্ন নীতি এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা, যা সাধারণত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে ‘রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক’। এই ব্যাংকগুলোতে এখন খেলাপি ঋণ কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকে ঋণের অর্ধেক খেলাপি ঋণে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের ৭২ শতাংশ, বেসিক ব্যাংকের ৬৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, বিডিবিএল এর ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকের ৩৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ৩১ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমান ১৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থাও একই রকম। নিরপেক্ষ তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের আসল চিত্র। খেলাপিসহ নানা সংকটে বড় অংকের মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকগুলো। যা প্রায় পৌঁণে ২ লাখ কোটি টাকা ছুঁইছুঁই। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক ব্যাংক খাত সংস্কারে কাজ চলছে।
প্রশ্ন: অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি কেমন? খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে কী ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছেন?
নাসের বখতিয়ার আহমেদ: অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি গত সেপ্টেম্বরে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। বর্তমানে তা কিছুটা কমে এসেছে। এরই মধ্যে ২০০ কোটি টাকা নগদ আদায় করেছি। খেলাপি আদায়ে পরিকল্পনা তো অবশ্যই রয়েছে। তবে চাইলে খেলাপি ঋণ মুহুর্তে আদায় করা যায় না। খেলাপি ঋণ আদায় করারও একটা প্রক্রিয়া রয়েছে। সেই প্রক্রিয়ায় আগাতে গেলেও দুই থেকে তিন বছর লাগবে। খেলাপি ঋণ আদায় করতে গেলে আইনের প্রক্রিয়াটাই অনেক জটিল। সেই জটিললতা শেষ করতে তো সময় চলে যায়। তাই সরকারের উচিত খেলাপিদের জন্য বিশেষ আদালত করে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। তাহলে কেউ সহজে আর খেলাপি হতে চাইবে না। এখন বছরের পর বছর ব্যাংকের টাকা না দিয়ে ঋণখেলাপিরা ঘুরে বেড়াতে পারে। সরকারের উচিত খেলাপিদের ব্যাপারে কঠোর হওয়া। যাতে অল্প সময়ের মধ্যে খেলাপিদের সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা সমন্বয় করতে পারা যায়। তবে সম্পদ বিক্রি করতেও রয়েছে নানা জটিলতা। এসব সম্পদ সঠিক দামে বিক্রি করতে গেলেও রয়েছে সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেট আগে থেকে বসে থাকে কিভাবে সম্পদের দাম কম দিবে। তার জন্য আদালত থেকে নিয়ে আসবে রায়ও। তাই সবখানে রয়েছে সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট ভাঙতে সময়ের প্রয়োজন।
প্রশ্ন: অগ্রণী ব্যাংকের আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাই ?
নাসের বখতিয়ার আহমেদ: আমানত ও ঋণ অগ্রণীর মোটামুটি অবস্থান রয়েছে। তবে রেমিট্যান্সে সবসময়ই আমাদের অবস্থান দ্বিতীয়, অর্থাৎ ইসলামি ব্যাংকের পরেই থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এটা দেখে অবাক হয়েছে। সরকারি ব্যাংক হিসেবে ডলার রেট বাংলাদেশ ব্যাংক যেটা বেঁধে দেয় তার বাইরে দেয়ার সুযোগ নেই। খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। ৫০ শতাংশের কাছাকাছি খেলাপি ঋণ চলে আসছে। ফলে মূলধন ঘাটতি দেখা গেছে। কিন্তু খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য এরই মধ্যে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। ডিজিটাল সার্ভিসের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে নেই। বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের ৯৭৯টি শাখায় অনলাইন সার্ভিস চালু আছে। অগ্রণী ব্যাংকে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, অ্যাননটেক্সের মতো বড় কোনো জালিয়াতির ঘটনা নেই। এ ধারাবাহিকতা আমরা ধরে রাখতে চাই। কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই), কৃষি খাতে ঋণ রয়েছে। এ খাতে আরো ঋণ বাড়ানো হবে। কারণ এ খাতে খেলাপি হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম। এদেশে উন্নয়নে ২৫ শতাংশ অবদান এ খাতেই বেশি। অথচ এখাতে মানুষ ঋণ পাই না। তাই যারা ভালো ব্যবসা করতে চাইবে, তাদেরকে আমরা ঋণ দিবে। নতুন করে কোনো কর্পোরেটে খাতে ঋণ দিচ্ছি না। তবে যেগুলো চলমান আছে, সেগুলো ব্যবসার পরিধি অনুযায়ি ঋণ দেয়া হচ্ছে। যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখতে পারে।
প্রশ্ন: এক সময় অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ছিলেন। এখন আবার চেয়ারম্যান হয়েছেন। ব্যাংকটির কোন তফাৎ দেখছেন কী?
নাসের বখতিয়ার আহমেদ: আমি যখন ২০০৪ সালে এমডি হিসেবে আসি তখন ব্যাংকের ইক্যুইটি প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ঋণাত্মক ছিল। খেলাপি ঋণ ছিল আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। আর নিট মুনাফা দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণাত্মক ছিল। তবে ২০১০ সালে বিদায় নেয়ার আগে ইক্যুইটি এক হাজার ৭২ কোটি টাকা ইতিবাচক ছিল। খেলাপি ঋণ কমিয়ে দুই হাজার ১০০ কোটি টাকায় নেমে আসে। আর ৩৫২ কোটি টাকা মুনাফা ছিল। কিন্তু এখন আবার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে দেখি মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। গত ১৫ বছর ঋণ ঠিকভাবে বিতরণ না করার কারণে এ পরিস্থিতি হয়েছে। তবে এ সংকট কাটিয়ে উঠবো।
প্রশ্ন: তারল্য সংকট থেকে বের হওয়ার উপায় কী?
নাসের বখতিয়ার আহমেদ: ব্যাংকখাতে বর্তমানে তারল্যসংকট একটি বড় সমস্যা। সবাই ব্যাংকে যায় টাকা উঠানোর জন্য অর্থাৎ ডিপোজিটের চেয়ে উত্তোলন বেশি। তার মানে এই নয় যে, তারল্য সংকটে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে। তবে আশা করছি, জুনের মধ্যে এই সংকট কেটে যাবে। বাহির থেকে ফরেন কারেন্ট ইনভেস্টমেন্ট আসার কথা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, আইডিবি ফান্ড আসলে আমরা ঘুরে দাঁড়াবো।
র/আ