শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫,
৫ মাঘ ১৪৩১
ই-পেপার

শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫
জাতীয়
ছোট হয়ে আসছে শীতকাল মাঘের বাতাসে বসন্তের আমেজ
শাহীন রহমান
Publish: Friday, 17 January, 2025, 8:19 PM  (ভিজিট : 17)

‘কথায় বলে মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’। শীত নিয়ে এই প্রবাদ বংশপরম্পরায় চলে আসছে। আজ মাঘের তিন তারিখ। কিন্তু প্রবাদের সঙ্গে মাঘের শীতের কোন মিল নেই। উল্টো মাঘের বাতাসে বসন্তের আমেজ অনুভূত হচ্ছে। পৌষ মাস শেষ হয়ে মাঘ শুরু হলে এখনও দেশে তীব্র শীত পড়েনি। চলতি মৌসুমে তিন ধাপে শৈত্যপ্রবাহ এলেও তীব্র হয়নি। দেশের অধিকাংশ জায়গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৩ থেকে ১৭ ডিগ্রির ঘরে।

আবহাওয়াবিদ শাহিনুল ইসলাম বলেন, আগামীকাল শনিবারের পর ক্রমশ তাপমাত্রা কমতে পারে। রোববার থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। গত মাসের আবহাওয়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি মৌসুমে শীত তার প্রকৃত চরিত্র নিয়ে এলেও পৌষ মাসের শেষে এসে শীতের চরিত্র দেখা যায়নি। দেশের উত্তরাঞ্চল ছাড়া বাকি অঞ্চলগুলোতে শীতের প্রকোপ অনেকটা কম। 

 বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তেঁতুলিয়ায়। এছাড়া অন্যত্র তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে রয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী শনিবার থেকে তাপমাত্রা কিছুটা কমতে পারে। তবে খুব বেশি কমার সম্ভাবনা নেই। শাহিনুল ইসলাম বলেন, এখন যেভাবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পারদ উঠছে। শীতের সময় এটা কিছুটা অস্বাভাবিক। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এখন পর্যন্ত এবার শীত কম।

গত বছর শীতের তীব্রতার পাশাপাশি, ব্যাপ্তি ছিল বেশি। পুরো পৌষ-মাঘ জুড়েই তীব্র শীতের অনূভূতি ছিল। এবারও পৌষের আগে সারাদেশে শীত বাড়ে। ঢাকায় এই তীব্রতা ছিল অনেক কম। দুএকদিন বাদ দিলে তীব্রতা অনুভূত হয়নি বলা চলে। এখন মাঘের শুরুতে অনেকটা বসন্তের আমেজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শীত ঋতুর উপর বেশি পড়ছে। এ কারণে শীতের সময়কাল খানিকটা কমে আসার বিষয়টিও উঠে এসেছে বেশ কিছু গবেষণায়। আগে দেখা যেত ডিসেম্বর জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি শীত থাকতো। এখন দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বরেও শীত আসে না। জানুয়ারিতে শীতের অনুভভুতি বাড়ে। মধ্য জানূযারি পর থেকে কমে যেতে থাকে।

একাধিক গবেষণায় শীতের সময়কাল কমে আসার বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রের ১৮৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়কালের আবহাওয়ার উপাত্ত নিয়ে গবেষণা করেন কেনেথ কংকেল। এতে দেখা যায়, দেশটিতে শীতের সময়কাল কমে আসছে। একইসঙ্গে শীতের সময় তুষারপাত ১০০ বছর আগের তুলনায় প্রায় এক মাস পর শুরু হচ্ছে। আর ১৯৭১ থেকে ১৯৮০ সালের তুলনায় ২০০৭ থেকে ২০১৬ সালে এই সময়টা পিছিয়েছে এক সপ্তাহ। সব মিলিয়ে ১৯১৬ সালের তুলনায় ২০১৬ সালের শীতকাল এক মাসেরও বেশি সময় কম ছিল। গবেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলেই এমনটা হচ্ছে।

আরেকটিই গবেষণায় দেখা গেছে, বাড়তে থাকা তাপমাত্রার কারণে পাহাড়ের উপরে তুষারপাত থাকার সময় কমে আসছে। এই তুষারপাত থেকে আসা পানির উপর নির্ভর করে লক্ষ প্রাণ বেঁচে থাকে। "আমাদের শীতকাল অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এর কারণও আমরা জানি," বলেন সান ডিয়াগোর দ্য স্ক্রিপস ইন্সটিটিউশন অব ওশেনোগ্রাফির অধ্যাপক আমাতো ইভান। তিনিই এই গবেষণাটি করেছেন। "এর কারণ জলবায়ু পরিবর্তন, এর কারণ বাড়তে থাকা তাপমাত্রা," বলেন তিনি। 

শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ্য করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শীতলতম মাস জানুয়ারি। কুয়াশা বাড়ার কারণে বর্তমানে শীতের তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে বলে জানান আবহাওয়াবিদ ড. মো. বজলুর রশিদ। গত কয়েক বছরের শীতের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, "ইদানীং শৈত্যপ্রবাহের সংখ্যা কমেছে কিন্তু ঘনকুয়াশার কারণে শীতের তীব্রতা বেড়েছে।" কুয়াশা কেটে যাওয়ায় শীতের তীব্রতাও কমে আসছে। বর্তমানে দেশের কোথাও ঘন কুয়াশা নেই। সন্ধ্যার পর শীতের আমেজ বাড়লেও বেলা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের তেজ বেড়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে শীতের অনূভূতি।

এদিকে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন বঙ্গোপসাগরে পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে জলীয়বাষ্প ব্যাপকভাবে উঠে বাতাসে মিশে যাচ্ছে। ফলে উত্তরের হিমেল হাওয়া বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এ কারণে মাঘের কাঙ্খিত শীতের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। আগামীতে মাঘের শীত বেশি বাড়ার আভাসও নেই। বর্তমান অবস্থা আরও কিছুদিন থেকে প্রকৃতি থেকে বিদায় নেবে শীত। আবহাওয়াবিদরা জানান মধ্য মাঘের পর থেকে শীতের অনুভূতি এমনিতেই কমতে থাকে। আজ মাঘের ৩ তারিখ। আরও ১২ দিন পর্যন্ত শীতল অনুভূতি পাওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির আভাস রয়েছে। বৃষ্টির আগে জলীয়বাষ্পের প্রভাব বেড়ে যাওয়া শীতের অনুভূতি আরও কমতে পারে। সব মিলিয়ে মাঘের বেশি শীত পড়ার আভাস মেলনি। 

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা অফিসের সাবেক জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শীত ঋতুর উপর বেশি পড়ছে। এ কারণে শীতকালের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকছে না। শুধু এবার নয় অতীতেও বহুবার এমন হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাকাশে সূর্যের অবস্থানের সাপেক্ষে পৃথিবীর অক্ষের অবস্থানের পরিবর্তনের কারণে কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঋতু পরিবর্তন সংঘটিত হয়। নাতিশীতোষ্ণ অক্ষাংশসমূহে চারটি ঋতু শনাক্ত করা যায়। তা হলো বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত ও শীত। ক্রান্তীয় অঞ্চলসমূহের রয়েছে দুটি ঋতু শুষ্ক ও আর্দ্র। ভারত মহাসাগরের আশপাশে অবস্থিত মৌসুমি এলাকাসমূহে রয়েছে তিনটি ঋতু শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা। তবে বাংলাদেশে আবহমানকাল থেকে ৬টি ঋতু বিরাজমান।
 
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি ঋতু হলো গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ও বসন্ত। এখানে শীত ঋতুর গুরুত্ব রয়েছে অনেক। কারণ শীতের আবহাওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে শীতকালীন ফসলের। যা এদেশে অন্য সময়ে আবহাওয়া কখনও উৎপন্ন হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতে যে বিরূপ আবহাওয়া শুরু হয়েছে এতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে ফসল উৎপাদনের ওপর। এছাড়া এ কারণে নানা ধরনের রোগ ব্যাধি প্রকোপ বাড়ে সঠিক মাত্রা শীতের অনুভূতি না থাকলে। ফলে শীতকালে শীতের আবশ্যকতা গুরুতপূর্ণ বলেও তারা মনে করছেন। আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী বাংলায় মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি শীত পড়ে। শীত ঋতুর প্রথম মাসের ব্যাপ্তিকাল এই সময়ের মধ্যেই। ফলে সবাই ধরেই নেয় পৌষে শীত জেঁকে বসবে। শীতের প্রস্তুতিও এই মাসকে ঘিরে থাকে। এরপর আস্তে আস্তে শীত কমতে থাকে। 

বৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী শীত ঋতুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিম্ন তাপমাত্রা, পশ্চিম অথবা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা শৈত্যপ্রবাহ, মুক্ত আকাশ আর বৃষ্টিহীনতা কিংবা যৎসামান্য বৃষ্টিপাত। জানুয়ারি মাসে গড় তাপমাত্রা দেশের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বভাগে ১৭ ডিগ্রী থেকে উপকূলীয় এলাকায় ২০ থেকে ২১ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেশের একেবারে উত্তর-পশ্চিমে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে এবং জানুয়ারি মাসের প্রথমভাগে, তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রী থেকে ৪ ডিগ্রীকে নেমে যায়। কিন্তু এবার ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে নামেনি। এখন তাপমাত্রা বাড়তির দিকে রয়েছে। রাজধানীতে স্বাভাবিক মাত্রায় আসেনি এখনও। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, জানুয়ারির শুরুতেই সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এতটা বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা। সাম্প্রতিক অতীতে এমনটা হয়নি। গত কয়েকদিন ধরেই রাজধানী ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রী থেকে তার ওপরে বিরাজ করছে। যা এই সময়ে একটি অস্বাভাবিক। 

বিগত ১০ বছরের আবহাওয়ার ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে শীত তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারছে না। মানছে না শীতে কোন প্যারামিটার। আবহাওয়াবিদদের মতে, শৈত্যপ্রবাহ শীতের একমাত্র কারণ নয়। অন্য আরও কয়েকটি কারণে শীত নেমে থাকে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের হিসাবে দেখা গেছে, শৈত্যপ্রবাহের ওপরই শীত বেশি নির্ভর হয়ে পড়ছে। কিন্তু এবার শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা কম হচ্ছে। যেটুকু শীত নেমেছে তা ঘন কুয়ার উপর নির্ভর করে। তা কেটে যাওয়ার পর এখন শীতের দেখা মিলছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শীত ঋতুতে শৈত্যপ্রবাহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ সুদূর সাইবেরিয়া থেকে যে ঠান্ডা বাতাস আসে তার কারণেই মূলত শীত আসে। কিন্তু অন্য কারণেও শীত অনুভূত হতে পারে। শীতে শীত নামবে, তাপমাত্রা কম থাকবে এটাই স্বাভাবিক। 

সূর্য দক্ষিণায়ন হওয়ার সঙ্গে দিনের পরিধি যেমন কমে আসে তেমনই তাপমাত্রাও আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এক পর্যায়ে তা বেশি মাত্রায় কমে গেলে প্রকৃতিতে শীত নেমে আসে। উপমহাদেশের উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়। এ চাপ বলয়ের কারণে ভারি বাতাস ওপর থেকে নিচে নেমে আসে। এর সঙ্গে জেড বায়ু (উর্ধাকাশের ঠান্ডা বায়ু) যুক্ত হয়ে নিচের বায়ু শুষ্ক ও ঠান্ডা করে দেয়। এছাড়া ঘন কুয়াশার ফলেও শীত অনুভূত হয়। বেশি পরিমাণ কুয়াশা থাকলে রাত ও দিনের তাপমাত্রা কাছাকাছি থাকে। দিনে পর্যাপ্ত আলো না থাকায় বেশি ঠান্ডা অনুভূত হয়। ওপরের ঠান্ডা বায়ুর (জেড বায়ু) প্রকোপ বাড়লে তাপমাত্রা কমে গিয়ে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে বৃষ্টিপাত হলেও শীত পড়ে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে শীত কোন প্যারামিটারই মানছে না।

আ. দৈ. /কাশেম/শাহীন

   বিষয়:  ছোট হয়ে আসছে   শীতকাল   মাঘের বাতাস   বসন্তের আমেজ  
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

দুদকের মামলায় বিএফআইইউয়ের সেই মাসুদ বিশ্বাস গ্রেফতার
এনসিটিবি’র সামনে সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০০ জনের নামে মামলা
ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেন যারা
বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক চায় ভারত: জয়সওয়াল
বাংলাদেশে নিপীড়ন বন্ধে প্রয়োজন স্থায়ী সংস্কার: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পথে
ফরিদপুরে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতারা গন সংযোগে ব্যস্ত
দক্ষতা ও নিষ্টার পুরস্কার, দুদকের মহাপরিচালক-পরিচালক পদে পদোন্নতি
চায়না পোশাকে সয়লাব দেশ
রাজনৈতিক ঐক্যে যাতে ফাটল না ধরে: সালাউদ্দিন
জাতীয়- এর আরো খবর
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মাসুদ আলম

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : [email protected]
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝