দেশের শেয়ার বাজারে ২০১০ সালের ভয়াবহ ধসের পর গত প্রায় দেড় দশকে তালিকাভুক্ত হওয়া অর্ধেকের বেশি কোম্পানির অবস্থাই এখন রুগ্ন। প্রিমিয়ামে আসা এসব কোম্পানির অনেকের ঠিকানা এখন ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে। কোনো কোনোটি বন্ধও হয়ে গেছে। এসব কোম্পানির মধ্যে ২৭ শতাংশের শেয়ারদর এখন ফেসভ্যালু ১০ টাকারও নিচে। এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে বিনিয়োগকারীরা। গত দেড় দশকে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা বিচার-বিশ্লেষণ করে হতাশাজনক এ তথ্যই উঠে এসেছে।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, একসঙ্গে এত অধিক সংখ্যক কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দাম অফারপ্রাইস শুধু নয়, অভিহিত মূল্যেরও নিচে চলে আসাটা খুবই হতাশার বিষয়। তারা বলেন, আইপিওর মাধ্যমে গত দেড় দশকে দুর্বল, মানহীন, দেউলিয়াগ্রস্ত কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আইপিওর নামে এ সময় যে পরিমাণ দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বুক বিল্ডিং প্রক্রিয়ায় এমনভাবে কারসাজি করা হয়, যাতে কোম্পানির মূল্যায়ন বোঝা না যায়। আর এ কারণেই বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আইপিও লিস্টিংয়ের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনই (বিএসইসি) সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ভয়াবহ ধসের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত ছিল, যে কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা হচ্ছে, সেই কোম্পানির ভবিষ্যৎ কী? কোম্পানির ভবিষ্যৎ নগদ অর্থ সঞ্চালনের সক্ষমতা কতটুকু? তারা তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কী ধরনের স্বচ্ছতা ও নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখে?—এ রকম আরও বিষয় যাচাই-বাছাই করে তালিকাভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু এটা না করে এমন সব কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যা শেয়ার বাজারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৫০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারদর অফার প্রাইসের নিচে, ২৭ শতাংশ ফেসভ্যালুর নিচে: ২০১০ সালে দেশের শেয়ার বাজারে ভয়াবহ ধসের পর এখন পর্যন্ত মোট ১৩২টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৬টি কোম্পানির শেয়ারদর অফার প্রাইসের নিচে চলে এসেছে। আর ফেসভ্যালুর নিচে চলে এসেছে ৩৬টি কোম্পানির শেয়ারদর, যা শতাংশের হিসেবে যথাক্রমে ৫০ ও ২৭ শতাংশ। গত প্রায় দেড় দশকের মধ্যে ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিএসইসির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. খায়রুল হোসেন। এ সময় দেশের শেয়ার বাজারে সবচেয়ে বেশি ৯৬টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। যার ৪৪টি কোম্পানিই ‘ভালো কোম্পানি’ বিবেচনায় প্রিমিয়ামে শেয়ার ছাড়ার অনুমতি পেয়েছে। অথচ এখন ৯৬টি কোম্পানির মধ্যে ৫৭টি অফার প্রাইসের নিচে চলে এসেছে, যা ৬১ শতাংশ। এর মধ্যে ৩২টি কোম্পানির শেয়ারদর আবার ফেসভ্যালু ১০ টাকারও নিচে চলে এসেছে, যা ৩৩ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিএসইসির চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। এই সময়ে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে বিভিন্ন খাতের মোট ৩৬টি কোম্পানি। এর মধ্যে ২৫ শতাংশই অফার প্রাইসের নিচে চলে এসেছে। আর ফেসভ্যালুর নিচে চলে এসেছে ৪টি কোম্পানির শেয়ারদর।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, গত দেড় দশকে প্রিমিয়ামে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিরগুলোর বেশির ভাগেরই অবস্থা খুবই খারাপ। এসব কোম্পানিকে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক বাছবিচার করা হয়নি। মানহীন, দুর্বল এসব কোম্পানি তালিকাভুক্তির দায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে নিতে হবে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এসব কোম্পানি আসলে শেয়ার বাজারে এসেছে তাদের শেয়ার বিক্রি করতে। আর এতে শোষিত হয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
ওয়েস্টার্ন মেরিনের ৩৫ টাকার শেয়ারের দাম এখন ৬ টাকা ৪০ পয়সা: দেশের শেয়ার বাজারের একটি আলোচিত কোম্পানি ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। প্রকৌশল খাতের কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০১৪ সালে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তাদের ৫১৯তম কমিশন সভায় কোম্পানিটির আইপিও অনুমোদন দেয়। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রিমিয়াম নেওয়া হয় ২৫ টাকা। অর্থাৎ, ২০১৪ সালে প্রিমিয়ামসহ একজন বিনিয়োগকারী ৩৫ টাকা দিয়ে কোম্পানিটির একটি শেয়ার কিনেছিলেন। তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি আয় দেখায় ৩ টাকা ৮৭ পয়সা। গতকাল রবিবার এই কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি হয়েছে মাত্র ৬ টাকা ৪০ পয়সায়। যা অফার প্রাইস শুধু নয়, ফেসভ্যালু ১০ টাকারও নিচে চলে এসেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য বলছে, আর্থিক দুরবস্থার কারণে কোম্পানিটি ‘এ’ থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নেমে এসেছে। কোম্পানিটি সর্বশেষ টানা তিন বছর ধরে লোকসানে আছে। এ সময় তারা বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি।
প্রিমিয়ামে আসা কোম্পানি অ্যাপোলো ইস্পাত এখন বন্ধ :প্রকৌশল খাতের আরেক কোম্পানি অ্যাপোলো ইস্পাতের অবস্থা আরও খারাপ। এই কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হয় ২০১৩ সালে। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রিমিয়াম নেয়া হয় ১২ টাকা। অর্থাৎ প্রিমিয়ামসহ একজন বিনিয়োগকারী ২২ টাকায় কোম্পানিটির শেয়ার কিনেছিলেন। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারমূল্য তিন টাকা ৬০ পয়সা। কোন বিনিয়োগকারী যদি দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগ করে থাকেন তাহলে গত এক দশকের বেশি সময়ে তিনি এ শেয়ার ধরে রেখে লাভ তো দূরের কথা উলটো প্রতি শেয়ারে লোকসান গুনছেন ১৮ টাকা ৪০ পয়সা। অবশ্য গত এক দশকের মধ্যে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে যথাক্রমে ৩ ও ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। ২০১৮ সাল থেকে লোকসানে থাকা কোম্পানিটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে বলে ডিএসই সূত্র জানিয়েছে। এমনকি ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে কোম্পানিটির সচিবের নম্বর পর্যন্ত দেওয়া নেই। শুধু এ দুটি কোম্পানিই নয়, অফারপ্রাইস ও ফেসভ্যালুর নিচে আসা বেশির ভাগ কোম্পানির অবস্থা একইরকম।
খারাপ অবস্থা ব্যাংক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানির :গত দেড় দশকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে বেশ খারাপ অবস্থা ব্যাংক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানির। এ দুটি খাতে মোট ১৬টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাতের ছয়টি ও বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের ১০টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। ব্যাংক খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো হলো: এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক ও এনআরবি ব্যাংক।
ডিএসইর তথ্য বলছে, এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে গতকাল সর্বশেষ কার্যদিবসে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ার ৯ টাকা ১০ পয়সা, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ার ৮ টাকা ১০ পয়সা, ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ার ৫ টাকা ৩০ পয়সা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার পাঁচ টাকা ৬০ পয়সায় লেনদেন হয়। যা ফেসভ্যালুরও নিচে।
এ সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে তালিকাভুক্ত ১০টি কোম্পানির মধ্যে সবগুলোই প্রিমিয়ামে (অফারপ্রাইস) এসেছে। কিন্তু এখন আটটি কোম্পানির শেয়ারদরই অফারপ্রাইসের নিচে নেমে এসেছে। এরমধ্যে ৪০ টাকা অফারপ্রাইসে আসা বারাকা পাওয়ারের শেয়ারদর এখন ১০ টাকা, ৪০ টাকা অফারপ্রাইসে আসা জিবিবি পাওয়ারে শেয়ারদর এখন ৭ টাকা ২০ পয়সা, ২৯ টাকা অফারপ্রাইসে আসা বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ারের শেয়ারদর এখন ১০ টাকা ৮০ পয়সা। এসব কোম্পানির তালিকাভুক্তির সময়ের বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এসব কোম্পানির মালিকরা তাদের বিনিয়োগের কয়েক গুণ অর্থ শেয়ারবাজার থেকে তুলে নিয়েছেন। তালিকাভুক্তির পর কিছু কোম্পানি উৎপাদনে নেই, আবার কোনো কোনো কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো ঘোষণা না দিয়েই মালিকদের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এত কিছুর পরও তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আইপিওর মাধ্যমে বাজারে আসা কোম্পানির মধ্যে ৫৬ দশমিক ৩ শতাংশ দুর্বল কোম্পানি। সম্প্রতি শ্বেতপত্র কমিটি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, শেয়ার বাজার থেকে গত দেড় দশকে এক ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতারণা, কারসাজিসহ প্লেসমেন্ট শেয়ার এবং আইপিও বা প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে জালিয়াতির মাধ্যমে শেয়ার বাজার থেকে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা একটি স্বার্থান্বেষী মহলের হস্তক্ষেপের কারণে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
দায় কার:মানহীন, দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্তিতে দায় কার-এ প্রশ্নটি এখন ঘুরেফিরে আসছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের শেয়ার বাজার ইকুইটি-নির্ভর। এখানে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত না হলে বাজারের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কিন্তু কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অধ্যাপক খায়রুল হোসেন ও শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের কমিশন অসাধু চক্রের সঙ্গে মিলে গত দেড় দশকে মানহীন, দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত করেছে। তিনি বলেন, আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে ডিএসইর মতামতকে গুরুত্ব দেয় না বিএসইসি। সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ডিএসইকে নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আইপিও তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে ইস্যু ম্যানেজারের।
মানহীন, দুর্বল কোম্পানির তালিকাভুক্তিতে ইস্যু ম্যানেজারের দায় প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মাজেদা খাতুন ইত্তেফাককে বলেন, একটি কোম্পানি নিয়ম মেনে তার সব কাজ পরিচালনা করছে কি না, এসব কিছু দেখেই ইস্যু ম্যানেজার কাজ করে। এছাড়া আফটার আইপিওতে-তো ইস্যু ম্যানেজার কাজ করে না।
এ প্রসঙ্গে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ইত্তেফাককে বলেন, বিএসইসির কাছে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের আবেদন দাখিল করলে বিএসইসি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিধিমোতাবেক অনুমোদন দিয়ে থাকে। কিন্তু প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের আবেদন প্রক্রিয়ায় বিএসইসি এককভাবে নয় বরং অডিট ফার্ম, মার্চেন্ট ব্যাংক, ইস্যুয়ার কোম্পানি, এক্সচেঞ্জ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো মিলিতভাবে কাজ করে থাকে। ফলে আইপিওর ভালোমন্দের জন্য বিএসইসি একক ভাবে দায়ী হতে পারে না।
আ. দৈ/ আফরোজা