ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে গর্জে উঠেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর দেশে ঘুষ, দুর্নীতি, ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি ও বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অনেকটাই নমনীয় ছিল দুদক। টানা ১৫ বছর রাজনৈতি এজন্ডা বাস্তবায়ন নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন।
কিন্তু গত বছর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে দুদক। ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্ব দুর্নীতি দমন কমিশন ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের চিহ্নিত প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ, দেশের অর্থ লুটপাট করে দেশে বিদেশে হাজার হাজার অবৈধ সম্পদের মালিকদের শক্তভাবে ধরার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।এই কমিশন দুদকের কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়ত ওইসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান, সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিশ জারি,অবৈধ সম্পদের মামলা দায়ের, দেশে ও বিদেশে সম্পদ জব্দ. ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ, পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য আইনী প্রক্রিয়ার পাশাপাশি দায়ের করা মামলয় বিচারিক আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল এবং বিচারিক কার্যক্রম পুরোদমে এগিয়ে যাচ্ছে।
দুদকের সূত্র মতে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এপর্যন্ত দুদকের কার্যক্রমের এক পর্যালোচনা করলেই দেখা যায় দুদক নামের দন্তহীন বাঘ কিভাবে গর্জন করে এগিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে দুদকের মামলার জালে শেখ হাসিনার পরিবার. সাবেক মন্ত্রী.এমপি ও আমলাসহ প্রভাবশালীরা আটকে পড়েছেন। গত ১৫ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্ত্বধীন সরকারের লোকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকসহ আর্থিক সেক্টর ধ্বংস করে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট এবং বিদেশে পাচারের চাঞ্চল্যকর অভিযোগের তথ্য প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
গতবছর ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে দিল্লীতে পালিয়ে যাবার পর শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, এমপি, নেতা ও আমলা সহ এক হাজারের বেশি প্রভাবশালী ব্যক্তি এবার দুদকের কারেন্ট জালে আটকেছে যাচ্ছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, বড় বড় প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি করে অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ নেওয়া ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এসব মামলা করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং দখলেরও অভিযোগ রয়েছে। আসামিদের কেউ কেউ টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন ও কানাডায় একাধিক বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, এমন অভিযোগেও মামলা হয়েছে।
দুদকের তথ্যমতে, গত জানুয়ারি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯মাসে ৭১৯ টি দুর্নীতি অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে। সম্পদের হিসেব চেয়ে নোটিশ পাঠানো হয়েছে ২১০টি। এই সময়ের মধ্যে ১৮১৪ জনের বিরুদ্ধে ৩৬০ টি মামলা দায়ের হয়েছে। বিচারিক আদালতে আগের দায়ের হওয়া মামলায় ৮৮৯ জনের বিরুদ্ধে ২৩২টি মামলায় সুপারিশসহ চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। একই সময়ে আগের দায়ের হওয়া ৫৫টি মামলার তদন্তে অভিযোগ সন্দোতীতভাবে প্রমাণীত না হওয়ায় ১৬২ জনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি (এফআরটি) প্রদান করা হয়েছে।
চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে সর্বাধিক ৭০টি ও ৫৪টি মামলা করা হয়। মামলায় আসামিদের মধ্যে ৩৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী ১১৪ জন, ৯২ জন রাজনীতিবিদ। এ সময়ে দুদকের জালে ফেঁসেছেন মোট এক হাজার ২৬৪ দুর্নীতিবাজ। এ সময়ের মধ্যে ২২৩ জনের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দিয়েছে সংস্থাটি। একই সময়ে ৯টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) করা হয়েছে।
গত ৯ মাসের দায়ের করা মামলায় আসামিদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ৩৪২ জন, বেসরকারি চাকরীজীবী ৯০৬ জন, ব্যবসায়ী ১৫৩ জন, রাজনীতিবিদ ১২৭ জন, জনপ্রতিনিধি ৪৩ জন, অন্যান্য শ্রেনি ও পেশার ২৪৩ জন। একই সময়ে আগের দায়ের হওয়া মামলায় সুপারিশসহ বিচারিক আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে আসামিদের মধ্যে সরকারি চাকরীজীবী ৩৬৬ জন, বেসরকারি চাকরিজীবী ২৩৩ জন, ব্যবসায়ী ৭৫ জন, রাজনীতিবিদ ২৩ জন, জনপ্রতিনিধি ২৭ জন, অন্যান্য শ্রেনি ও পেশার ১৬৫ জন।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সঠিকভাবে অনুসন্ধান না করে তাড়াহুড়া করে মামলা করতে গিয়ে কিছু ভুলও হয়েছে। এসব ভুলের কারণে অপরাধ প্রমাণ করতে বেগ পেতে হতে পারে। আরো ভালোভাবে অনুসন্ধানের পর মামলা করলে অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। দলীয় সরকারের ইচ্ছার বাইরে কোনো দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করা কঠিন। এসব অভিযোগ দীর্ঘদিনের, আগের সরকারগুলো দুদককে নিজেদের ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করেছে।
দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর আগে সরকারের ‘সবুজসংকেত’ লাগত। বড় কোনো ঘটনার খবর গণমাধ্যমে এলে লোকদেখানো অনুসন্ধান শুরু হলেও বেশির ভাগ সময়ই তা আর এগিয়ে নেওয়া হতো না। এমনকি দুর্নীতির পর্যাপ্ত প্রমাণ থাকার পরও অনেককে দায়মুক্ত ঘোষণা করার উদাহরণও রয়েছে। বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের বিরুদ্ধেও যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই অনুসন্ধান করা হবে। শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কেউ অভিযুক্ত হবেন না। আমরা প্রমাণ ভিত্তিক কাজ করা হচ্ছে।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুদক ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর চেষ্টায় গতি আনতে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে লন্ডন সফর করেন দুদক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। গত ১৬ জুন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এখন যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের বিরুদ্ধেও যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে, অবশ্যই অনুসন্ধান করা হবে। শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কেউ অভিযুক্ত হবেন না। তথ্য প্রমাণ ভিত্তিক কাজ করে দুদক।
’ শেখ পরিবারের দুর্নীতি প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান গণমাধ্যমকে বলেন,‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নির্বাচনী হলফনামায় যে সম্পদের বিবরণ দিয়েছেন, তা আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। তিনি অনেকাংশেই সম্পদের বিবরণে তথ্য গোপন রেখেছেন। শেখ হাসিনা ও তাঁর সন্তান এবং বোনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আরও দু-একটি মামলা অনুসন্ধানে রয়েছে।’
হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা : শেখ হাসিনা ও তাার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে আলাদা কমিটি করেছে দুদক। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা ও তাদের পরিবারের নামে বরাদ্দ নেওয়া প্লটের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করা হয়। ৬ট মামলাতেই দুদক আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। মামলাগুলো এখন আদালতে বিচারাধীন।
১০ কাঠা করে মোট ২০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে গত ১৪ জানুয়ারি দুটি মামলা করা হয়। একই অভিযোগে শেখ রেহানা এবং তার মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক (রূপন্তী) ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের (ববি) বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়। এই তিন মামলায় রেহানার আরেক মেয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান থেকে ‘ঘুষ’ হিসেবে ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগে টিউলিপের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে। মামলাটি এখন তদন্তাধীন।
দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, ‘দুদক আইনের মধ্যে থেকে নিজস্ব গতিতেই কাজ করছে। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে নিয়ম অনুযায়ী যাচাই-বাছাই শেষে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কমিশন। অনুসন্ধান শেষে মামলা ও চার্জশিট দেওয়ার কাজও চলছে। এক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের রাজনৈতিক কিংবা পেশাগত পরিচয় দেখা হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান অনুসন্ধান, মামলা ও চার্জশিটেও সেটা দৃশ্যমান।’
আ. দৈ./কাশেম