ডাকসু নির্বাচনের প্রথমবারের মতো উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছে। নির্বাচনে অধিকাংশ পদেই শিবিরি সমর্থিত এক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের সদস্যরা জয়লাভ করেছে। অপর রদিকে ভরাডুবি হয়েছে ছাত্রদলের সমর্থিত প্যানেলের। ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠা পেয়ে ক্ষমতায় যাবে বলেই অধিকাংশের ধারণ। তার আগে ডাকসু নির্বাচন ছিল একটি টেস্ট কেস। কিন্তু এ নির্বাচনে ফল বিএনপি অনেকটা ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। বিশ্লেষণ চলছে কেন বিএনপির ছাত্র সংগঠনের এমন ভরাডুবি। আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব কতটা পড়তে পারে।
যদিও ছাত্রদল ঢাকসু নির্বাচনের ফল প্রত্যাখান করেছেন। তাদের অভিযোগ নির্বাচনে ব্যাপক কাচচুপি হয়েছে। কিন্তু এটা এখন পর্যন্ত অভিযোগের পর্যায়েই আছে। কারচুপির প্রমাণ হয়নি। প্রশাসনের ভুমিকা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছে। তবে ছাত্রদলের পক্ষ থেকেই যাই অভিযোগ করা হোক না কেন সংশ্লিষ্টরা বলছেন বিএনপির এখনো পুরাতন রাজনীতির ধ্যান ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। ৫ আগস্টের পর তারা অলিখিতভাবে ক্ষমতাসীদের মতো আচরণ করছে। অধিকাংশ স্থানে চাঁদাবাজির দখলবাজি বিএনপির নেতৃত্বে চলছে। মানুষ ১৬ বছরের অপশাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিল।
এ কারণে তারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার পতনের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে। ৫ আগস্ট ষেক হাসিনা পালিয়ে গেলে যেনই যন্ত্রনা থেকে রেহাই পায়নি। নতুন করে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা চাদাবাজি, দখলবাজী, মামলা বাণিজ্য মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ। তার একটা প্রভাব ডাকসু নির্বাচনে পড়েছে। এর পিরবীতে ছাত্র শিবিরের আচরণ অনেকটা বিনয়ী। এছাড়া ৫ আগস্টের পর দলের বদনাম হয় কোন কোন অপকর্ম শিবিরের কারো বিরুদ্ধে পাওয়া যায়নি। এ কারণে স্বাধীনতা বিরোধী ট্যাগ নিয়ে মন্দের ভালো হিসেবে এবারের ডাকসু নির্বাচনে শিবিরকেই বেছে নিয়েছে শিক্ষার্থী।
এছাড়াও শিবিরের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কৌশল, প্রযুক্তি ব্যবহারে তারা অনেকটা এগিয়ে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইমলামী ছাত্র শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট, বিএনপির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বামপন্থি সাতটি ছাত্রসংগঠনের প্যানেল প্রতিরোধ পর্ষদ, এনসিপির ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদসহ আরো অনেক দলের প্যানেল ছিলো এবারের ডাকসু নির্বাচনে। ২০২৪-এর ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র নেতারাও এবার প্রার্থী হয়েছিলেন। নির্বাচনে ডাকসুর ভিপি, জিএস এবং এজিএসসহ প্রায় সব পদে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে।
হল সংসদগুলোতেও তাদের জয় জয়কার। আর কেন্দ্রীয় সংসদে তাদের জয় বিশাল ভোটের ব্যবধানে। ভিপি পদে ছাত্র শিবিরের আবু সাদিক কায়েম ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। ছাত্রদলের প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান পাঁচ হাজার ৭০৮ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন। জিএস পদে ছাত্র শিবিরের এস এম ফরহাদ ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন ছাত্রদলের তানভীর বারী হামিম।
তিনি পেয়েছেন পাঁচ হাজার ২৮৩ ভোট। এজিএস পদে শিবিরের মুহা. মহিউদ্দিন খান ১১ হাজার ৭৭২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন ছাত্রদলের তানভীর আল হাদী মায়েদ। তিনি পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৬৪ ভোট। ডাকসুতে ১২টি সম্পাদকীয় পদসসহ মোট পদ ২৮টি। এর মধ্যে তিনটি বাদে আর সব পদেই তাদের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন গত ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামলে রাজনীতির মাঠে বিএনপি ছিল কোনঠাসা। রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ না হলেও মামলা মোকাদ্দমা মোকাবেলায় হাপিয়ে উঠছিল দলটির নেতাকর্মীরা। এছাড়া দলের নেতৃত্ব দেয়ার মতো দেশে কেউ ছিল না। জেল, মামলা ও হুলিয়া মাথায় নিয়ে সুদুর লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করেছেন তারেক রহমান। ফলে রাজনৈতিক ভাবে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম দুর্বল ছিল। দলীয় কোন্দলের কোনঠাসা।স ৫ আগস্টের পর এই ক্রোন্দল শতগুনে বেড়েছে।
অপর দিকে জামায়াতও নিষিদ্ধ না হলেও এ সময় তারা প্রকাশ্যে কোন তৎপরতা চালাতে পারেনি। সরকারে কঠোর দমনপীড়নের তারা কৌশল পরিবর্তন করেছে টিকে থাকার জন্য। পরিচয় গোপন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ব্যানারে ঢুকে সংগঠন পরিচালনা করেছে। এছাড়া ভিন্ন নামে নানা সংঠনের সাথে জড়িত থেকে কর্মকান্ড এগিয়ে নিয়েছে। ছদ্মনামে তারা ১৬ বছরের নিজেদের কর্মকান্ডের অনেক বিস্তার ঘটিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তারা অবস্থান শক্তিশালী করতে পেরেছে। ফলে এ অর্জন তাদের প্রত্যাশিত ছিল বলেই তারা মনে করছেন।
এছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছে ৫ আগস্টের আগে শিবির কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে আসেনি। ৯১ সালের পর থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ পালাবদলে দেশের ক্ষমতায় ছিল। সে সময় দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ক্ষমতাসী দলের নেতাকর্মীদের কাছে সাধারণ ছাত্ররা ছিল অসহায়। নানাভাবে নির্যাতনের শিকার ছিল।
প্রতিরোধের উপায় খুজছিল। এ প্রক্রিয়ায় তারা দুদফায় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের আচরণ সম্পর্কে অবগত। এছাড়া গত ১৬ বছরের ছাত্রলীগের অত্যাচার নির্যাতহনের মাত্রা সীমা ছাড়িয়েছিল। পিঠে দেয়াল ঠেকেছিলো। তারাই বিষ্ফোরণ হলো জুলাই আন্দোলন। আর এই আন্দোলনে বড় ভুমিকা পালন করেছে ছাত্র শিবির। এ কারণে শিভির সম্পর্ক তাদের মন্দের ভালো বলে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে।
এছাড়া বর্তমানে ছাত্র লীগ নিষিদ্ধ হলেও সংগঠনের একটি ভোট ব্যাংক রয়ে গেছে। অনেকে ধারণা করছেন তাদের ভোটও শিবিরের প্যানেলে গেছে। ফলে তাদের জয়টা আর সহজ হয়েছে। তারা বলছেন ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যত মামলা হামলা হয়েছে তা মুলত বিএনপির নেতাকর্মীদের দ্বারা সংগঠিত। সেই ক্ষোভ থেকেও দলটির ভোট শিবিরের বাক্সেও পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন মনে করেন, শিবিরকে যারা ভোট দিয়েছেন তারা যে সবাই শিবিরের আদর্শ চিন্তা করে ভোট দিয়েছেন তা নয়, তারা ক্যাম্পাসে দখলদারীর ছাত্র রাজনীতির আশঙ্কা থেকে ভোট দিয়েছেন। কারণ তারা অতীতে অনেক ছাত্র সংগঠনের দখলদারিত্বের রাজনীতি দেখেছেন, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের রাজনীতি দেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই বিবেচনায় শিবিরের রেকর্ড নাই। আর ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে তাদের বড় একটা ভূমিকা ছিলো।
আর শিবিরের বিরুদ্ধে যে ছাত্র সংগঠনগুলো ছিলো তাদের পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব ছিলো। এটাও শিবিরকে সুযোগ করে দিয়েছে। তবে শিবির যত বেশি ভোট পেয়েই জয়ী হোক না কেন তারা ক্যাস্পসে যদি মুক্তিযুদ্ধেরবিরোধী অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে চায়, রাজাকারদের প্রতিষ্ঠা চায়, তাহলে এই ছাত্ররাই তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। তারা এক পাও এগোতে পারবে না,” বলে মনে করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ছাত্রশিবির মুহূর্তের মধ্যে কৌশল বদলাতে পারে। ভয়ঙ্কর এক কৌশল গ্রহণ করেছিল তারা আওয়ামী জমানায়। শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে তারা অবিশ্বাস্য কৌশল গ্রহণ করেছিল। তারা ঢুকে পড়েছিল ছাত্রলীগের মূলস্রোতে। এটা ছিল দলীয় সিদ্ধান্তে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে যারা মূল নেতৃত্বে এসেছে তাদের সবার ইতিহাস এখন জানা। অনেকেই শিবির থেকে ছাত্রলীগে আবার ছাত্রলীগ থেকে শিবিরে ফিরেছেন।
এর বিপরীতে হাসিনার ১৬ বছরের শাসনে ছাত্রদলের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। না ছিল কমিটি, না ছিল বিচ্ছিন্ন অবস্থান। শুধু ঝটিকা মিছিল দিয়েই জানান দেয়া হয়েছিল- আমরা আছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদলের কোনো নাম-নিশানাই ছিল না। শেখ হাসিনা জাতীয়তাবাদী শক্তিকেই মূল টার্গেটে পরিণত করেছিলেন। ২০২৩ সনের ২৮শে অক্টোবর বিএনপির বিশাল জনসভা ভেঙে দিল হাসিনার প্রশাসন। কিন্তু একই দিনে র্যাব পাহারায় অনুষ্ঠিত হয় জামায়াতের জনসভা।
এতকিছুর পরও বিএনপি নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে তাদের রাজনীতি সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। পরিণতিতে এখন সামন্যতম কৌশলের কাছেই হেরে যাচ্ছেন। ঘর রয়েছে অগোছালো। অথচ বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে চাচ্ছেন পুরনো মারপ্যাঁচে। এটা যে হবার নয়, তা তো ডাকসুতে দেখা গেল। বলাবলি হচ্ছে- ছাত্রলীগের ভোট কারা পেল। অনেকেই বলছেন, সহজ হিসাব। শিবিরকেই তারা ভোট দিয়েছেন তাদের নতুন ন্যারেটিভে। তারা দেখাতে চান দুনিয়াকে- আমাদের পতনের পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
এছাড়াও ৫ই আগস্টের পর বিএনপির আচরণে অনেক অভিভাবক বিক্ষুব্ধ। এর প্রতিফলন দেখা গেছে ভোটের বাক্সে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মোটেই নিরপেক্ষ ছিল না। তারা কখনো লম্বা ছুটি দিয়েছে ভোটের আগে। সমালোচনার মুখে আবার ছুটি বাতিলও করেছে। এটা ছিল তাদের কৌশলের অংশ। রক্তের গ্রুপ দেখে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। কিছু ব্যতিক্রমও দেখা যায়। পর্দার আড়ালের রাজনীতির খেলাও এখানে অনেকটাই স্পষ্ট ।
প্রশ্ন উঠতেই পারে- নির্বাচন নিয়ে পর্দার আড়ালে অনেক আগেই কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল? যার সূক্ষ্ম বাস্তবায়ন দেখা গেল ভোটের দিন! ছাত্রদলের কোনো সাংগঠনিক ভিত্তিই ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাতীয় রাজনীতির আবহ দিয়ে বাজিমাত করা যে সম্ভব নয়- এটা বিএনপি নেতারা এখন বুঝতে পারছেন। এর মধ্যে নিজেদের ভেতরে কোন্দল এতটাই প্রবল ছিল যে, প্রকাশ্যে কেউ কেউ ক্যাম্পেইন চালিয়েছেন। নানা সমালোচনা ছিল তাদের মুখে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক মুখ্য ভূমিকা রেখেছে এই নির্বাচনে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ডাকসুর শতবর্ষপূর্তির বছরে অনুষ্ঠিত এই ৩৮তম নির্বাচন ছয় বছর পর আয়োজন করা হয়। তবে সারাদিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হলে প্রতিদ্বন্দ্বি প্যানেলের প্রার্থীরা বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ উত্থাপন করে। এর জবাবে প্রতিষ্ঠানটির ভিসি জানিয়েে যখন যে অভিযোগ পাওয়া গেওেছ তাকৎক্ষণি সমাধানে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এদিকে প্রথমবারের মতো ভোটগ্রহণ আবাসিক হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে আয়োজন করা হয়। নিবন্ধিত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস জুড়ে নির্ধারিত আটটি কেন্দ্রে স্থাপিত ৮১০টি বুথে ভোট দেন। শিক্ষার্থীরা কার্জন হল, টিএসসি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্লাব, সেনেট ভবন, উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভূতত্ত্ব বিভাগ, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভোট প্রদান করেন। মোট ৪৭১ জন প্রার্থী ডাকসুর ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, আর ১ হাজার ৩৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন হল সংসদের ২৩৪টি পদে। ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৯ হাজার। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-সমর্থিত জোট, বামপন্থী জোট ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে।
নির্বাচন উপলক্ষে ক্যাম্পাসে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং ভোট গণনার সরাসরি সম্প্রচার কেন্দ্রে বাইরে স্থাপিত এলইডি স্ক্রিনে প্রদর্শনের উদ্যোগ নেয়া হয়। পুরো ভোটগ্রহণ চলাকালীন কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেনি। প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, যা দেশের জন্য একটি মডেল হতে পারে। ফলাফল রাতে ১১টার পরে ঘোষণা করা হয়।
এদিকে ভোট গ্রহণের পর সন্ধ্যায় বিছিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করে। ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে ভিসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতমুলৈক অভিযোগ আনা হয়েছে। অপর দিকে শিবির সমর্থথিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচরেন আচরণবিধি লঙ্ঘণের অভিযোগ আনা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সহ সভাপতি ( ভিপি) প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান। তিনি বলেছেন, যদি ভোটগণনাতে বিন্দুমাত্র কারচুপির চেষ্টা করা হয়, যদি শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের অধিকার দমন করার অপচেষ্টা হয়, শিক্ষার্থীরা তা প্রতিরোধ করবে। সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা বারবার প্রমাণ পেয়েছি যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আজকের নির্বাচনে একাধিক অনিয়ম আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। রোকেয়া হল এবং অমর একুশে হলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন যে তাদের দেয়া ব্যালটে আগে থেকেই নির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে ভোটচিহ্ন দেয়া ছিল। প্রধান রিটার্নিং অফিসারের অনুমতিতে তদন্তে গিয়ে আমরা নিজেরাই এ ধরনের ব্যালট দেখতে পেয়েছি। আমাদের এজেন্ট এবং প্রার্থীদের বারবার হয়রানি করা হয়েছে।’
এদিকে ডাকসু নির্বাচনের টিএসসির ভোট কেন্দ্রে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম ও ছাত্রদল সমর্থিত ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলামকে ঢুকতে দেয়া হলেও উমামা ফাতেমার প্যানেলের ছাত্র পরিবহন সম্পাদক রাফিজ খানকে ঢুকতে না দেয়ায় হট্টগোল করেছে তাঁর সমর্থকেরা। পরে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সমর্থকেরাও এতে যোগ দেয়। বিকেল পৌনে চারটার দিকে টিএসসির জনতা ব্যাংকের বুথের সামনে এই ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাফিজ খান বলেন, ‘বিকেলের পর থেকেই আমি টিএসসিতে ঢুকতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমাকে দেয়া হয়নি। অথচ ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম ও ছাত্রশিবিরের ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েমকে ঢুকতে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় সাদিকের সঙ্গে আরও দশজন ভেতরে প্রবেশ করেছে।’ তিনি বলেন, ‘বিষয়টি দায়িত্বরত শিক্ষককে জানানো হলে তিনি সাদিকের সঙ্গে অন্যদের ঢোকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তাই আমরা তাৎক্ষনিক ক্ষোভ জানিয়েছি। পরে টিএসসির ভেতরের পায়রা চত্বরের নিচে আবু সাদিক কায়েম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকাল থেকে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু আমরা দেখতে পেয়েছি একটা গোষ্ঠী নির্বাচন বানচালের জন্য ষড়যন্ত্র করছে। আমরা দেখতে পেয়েছি বহিরাগত বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের পাশে ভিড় করছে। যারা ষড়যন্ত্র করছে তাদের আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা যে রায় দেবে অবশ্যই আমরা সেটা গ্রহণ করব।’
এদিকে প্রার্থীরা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করলেও ভোটের বড় কোনো অনিয়মের খবর পাওয়া যায়নি। আটটি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এ ভোটের ব্যালট গণনা করা হয় ১৪টি মেশিনে। এগুলোর কোনোটির স্ক্যানিং স্পিড- ঘণ্টায় ৫০০০, কোনোটির ৮০০০ পাতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন থেকে ভোটের ফল ঘোষণা করা হয়।
ডাকসু নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান জানিয়েছেন, ডাকসু নির্বাচনে স্বচ্ছতার ঘাটতি নেই। বিকাল ৩টার দিকে সিনেট ভবনের তিনটি কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, ইতোমধ্যে বিভিন্ন কেন্দ্রে ৭০ শতাংশের বেশি ভোট সংগ্রহ হয়েছে।
উপাচার্য বলেন, কার্জন হলে ভুলক্রমে একটি ছোট সমস্যা হয়েছে। তার জন্য আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। তবু এ ঘটনার আমরা পুনরায় তদন্ত করে কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেব। উল্লেখ্য, কার্জন হলে এক ভোটারকে দুটি ব্যালট দেওয়া হয়েছিল। পরে পোলিং অফিসারকে প্রত্যাহার করা হয়। কড়া নিরাপত্তায় শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট শেষ হয়েছে। তবে ভোট গ্রহণ নিয়ে প্রার্থীদের কেউ কেউ অভিযোগও করেছেন।
এদিকে নির্বাচনে বেশ কয়েকটি ব্যত্যয় হয়েছে অভিয়োগ করে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবি সমর্থিত প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী এসএম ফরহাদ বলেন, নির্বাচন কমিশনকে জানানো হলেও তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্টকে বের করে দেয়ার অভিযোগ করেছেন ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী খায়রুল হাসান।
ডাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী উমামা ফাতেমা বলেন, তিনি জয়ের ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী। সেই সঙ্গে উমামা বলেন, তার চাওয়া, ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন’ হোক। টিএসসি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে এসে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার বলেন, আনন্দায়ক পরিবেশে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন আমরা দেখতে পেয়েছি।
আমরা আশাবাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা তাদের যোগ্য নেতৃত্ব বেছে নেবেন। ডাকসু নির্বাচনের ব্যালটে প্রগতি পক্ষের যে শক্তিগুলো আছে, সেই শক্তিগুলোর জয় হবে বলে মন্তব্য করেন প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী মেঘমল্লার বসু। ডাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী শামীম হোসেন বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে ট্যাগিংয়ের মাধ্যমে, প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে তার ভোট কমানোর চেষ্টা চলছে।
এদিকে ডাকসু নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পালানকালে তরিকুল ইসলাম নামের এক সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের ভেতরে ডাকসু নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন তরিকুল। দুপুর দেড়টার দিকে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। অচেতন অবস্থায় তরিকুলকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
এদিকে নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে চেকপোস্ট বসানো হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে মোতায়েন করা হয়। নিরাপত্তার জন্য টিএসসি এলাকায় পুলিশের একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ করা হয়। পাশাপাশি সব কটি প্রবেশপথে শিক্ষার্থীদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি ছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা।
কেন্দ্র ভিত্তিক ভোটের হার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে আটটি কেন্দ্রের মধ্যে সাতটিতে প্রাথমিকভাবে ভোট পড়ার হার পাওয়া গেছে। অনানুষ্ঠানিক হিসাব উল্লেখ করে রিটার্নিং কর্মকর্তারা যে তথ্য জানিয়েছেন, তাতে কেন্দ্রভেদে ৬৫ থেকে ৮৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। একটি কেন্দ্রের হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি।
ডাকসুতে মঙ্গলবার সকাল আটটায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়। শেষ হয় বিকেল চারটায়। পরে রির্টানিং কর্মকর্তারা প্রাথমিক হিসাব দিয়ে জানান, কার্জন হল কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের বেশি, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে ৮৩, টিএসসি কেন্দ্রে ৬৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব কেন্দ্রে ৬৭, উদয়ন স্কুল কেন্দ্রে ৮৪-৮৫, ভূতত্ত্ব বিভাগ কেন্দ্রে ৬৫ এবং ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি কেন্দ্রে ৬৫ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে।
এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সিনেট ভবন কেন্দ্রের হিসাব পাওয়া যায়নি। ওই কেন্দ্রে তিনটি হলের মোট ভোটারসংখ্যা ৪ হাজার ৮৩৫। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত হিসাব দিয়ে সেখানকার রিটার্নিং কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ৪ হাজারের মতো ভোট পড়েছে (প্রায় ৮৩ শতাংশ)। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রদের হলগুলো থেকে ভোট বেশি পড়েছে। ভোট পড়ার হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের বেশি। ছাত্রীদের হলে ভোট পড়েছে ৬৫ থেকে ৬৯ শতাংশ। তবে ছাত্রীদের ভোট পড়ার এ হারও উল্লেখযোগ্য বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
আ. দৈ./কাশেম