জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (ওএসডি) ডা.ফাতেমা দোজার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের শেষ নেই। গত ১২ বছর বেতন-ভাতা তুলেছেন অবৈধভাবে। বারবার অনিয়ম করেও কর্তৃপক্ষের শোকজ বা তলব কোনোটাই পাত্তা দেননি। স্বামীর পদবি ও রাজনৈতিক দাপটে পার পেয়ে গেছেন বলে অভিযোগ। চাকরির শেষে এসে ছয় অপরাধে চূড়ান্ত বরখাস্তের মুখোমুখি
এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় চার মাস একদিনের কারাবাসের তথ্য গোপন, রেডিওলজি সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকার (আরএনএসএ) আমন্ত্রণ জালিয়াতি এবং এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির পরপর নোটিশের জবাব না দেওয়া, চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়া, তৎপরবর্তী এক বছর চার মাস ১২ দিন ‘পলায়ন’, সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৩ (খ) অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগসহ বিভাগীয় মামলায় আনীত ছয়টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
ফলে তাকে চূড়ান্ত বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মতামত জানতে চাইলে ‘গুরুদণ্ডস্বরূপ চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যায়’ মর্মে সম্মতি দিয়েছে। এখন বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন প্রকাশের প্রক্রিয়া চলমান।
২৫ জানুয়ারি ১৯৯৯ তারিখে সহকারী সার্জন হিসেবে নিয়োগ পান ফাতেমা দোজা। বিসিএস ১৮ ব্যাচের এ কর্মকর্তার চাকরি যথারীতি ১ মে ২০০৪ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। বিপত্তির শুরু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় গৃহপরিচারিকা নির্যাতন দিয়ে। এরপর থেকে পুরো ২০ বছরই কেটেছে একের পর এক অনিয়ম ও জালিয়াতি করে।
২ মে ২০০৪ তার বিরুদ্ধে গৃহপরিচারিকাকে গরম ইস্ত্রি দিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতনের দায়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে রমনা থানায় মামলা হয়। মামলা নম্বর ৪(৫)২০০৪। ৩ মে গ্রেফতার হন তিনি, মুক্তিপান ৪ মে ২০০৪ তারিখে। কাজে যোগ দেন ১১ মে ২০০৪ তারিখে। মাঝখানে চার মাসের বেশি সময় কারাবাসের তথ্য গোপন করেন। এ সময়ে বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক নিশ্চিত করেন। কারাবাসের বিষয়টি অভিযুক্ত ফাতেমা দোজা স্বীকারও করেন।
তবে দাবি করেন, মুক্তির পর এটি বিভাগীয় প্রধানকে জানিয়ে ছুটি নিয়েছেন। কিন্তু এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই তার কাছে। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৩ (গ) অনুযায়ী এটি পলায়ন হিসেবে গণ্য করা হয়।
গৃহপরিচারিকা নির্যাতন ও কারবাসের ঘটনা মোটামুটি সামলে উঠে, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যোগদান করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হন। ২২ ফেব্রুয়ারি সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে সচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেন।
এটি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠান। এর এক বছর চার মাস ১২ দিন পর ২৫ মার্চ ২০১৩-তে স্বাস্থ্য সচিব বরাবর অব্যাহতির আবেদনটি প্রত্যাহারের আবেদন করেন। যদিও সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি চাওয়ার পর ফেরত আসার বিধিগত কোনো সুযোগ নেই বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা সরকারের যুগ্ম সচিব আনোয়ার হোছাইন আকন্দ। তদন্তে আবেদনকারীর কোনো আবেদন বা চাকরি ফেরতের কোনো বৈধ কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এরপর হুট করেই ১০ জুন ২০১৩ তারিখে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান এবং তাকে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগে পদায়ন করা হয়। তিনি পরদিন ১১ জুন ২০১৩ তারিখে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে যোগদান করেন। একই হাসপাতালে থাকাকালীন ২৯ আগস্ট ২০১৭ সালে সহযোগী অধ্যাপক অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পান। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। যদিও সেগুলো ধামাচাপা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। পরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটি ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা পায়। যার সন্তোষজনক জবাব ডা. ফাতেমা দোজা দিতে পারেননি।
একের পর এক অনিয়ম করে পার পেয়ে ভয়ঙ্কর জালিয়াতি করে বসেন আন্তর্জাতিক সেমিনারের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে। ২৭ নভেম্বর ২০২২ থেকে ৪ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে রেডিওলজি সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকার (আরএনএসএ) ১০৮তম বার্ষিক সভা এবং বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের আমন্ত্রণপত্র পান তিনি। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এ ঘটনা সন্দেহ হলে মন্ত্রণালয় তদন্ত করে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে মেইল করে। জবাবে আরএনএসএ জানায় আবেদনটি অল্টার করা হয়েছে। তখন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি করে। ওই কমিটি পরপর দুটি শোকজ দিলেও জবাব দেননি ডা. ফাতেমা দোজা। এটিও সরকারি চাকরি বিধিমালার ৩ (খ) মোতাবেক অসদাচরণ বলে গণ্য হয়।
ডা. জামাল নিজেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০০৪ সালের মে মাসে রমনা থানায় দায়ের করা ৪(৫) ২০০৪ নম্বর মামলার আসামি হওয়ায় ২ মে গ্রেফতার হয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজতবাস শেষে ৭ জুন মুক্তি পান। ডা. জামাল ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার হয়ে হাজতবাসের তথ্য গোপন করে ২০ বছর চাকরি করে বিভিন্ন পদে পদোন্নতি ও আর্থিক সুবিধা লাভ করে ফ্যাসিস্ট সরকারের নেক নজরে থেকে গত বছরের জানুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। স্ত্রীকেও একই সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
বিভাগীয় মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডা. ফাতেমা দোজাকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী অসদাচরণ ও পলায়নের দায়ে অভিযুক্ত করে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অন্য কোনো যথোপযুক্ত দণ্ড দেওয়ার নোটিশ দিয়ে ২০২৩ সালের ২৬ নভেম্বর বিভাগীয় মামলা (মামলা নম্বর ৪২/২০২৩) দায়ের করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের শৃঙ্খলা অধিশাখা। ডা. ফাতেমা দোজাকে কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব এবং ব্যক্তিগত শুনানি চান কি না তা জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ডা. ফাতেমা দোজা ওই নোটিশের জবাব না দেওয়ায় বিভাগীয় মামলার পরবর্তী ধাপ হিসেবে গত বছরের ১০ মার্চ তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম-সচিব আনোয়ার হোসাইন আকন্দ গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে ডা. ফাতেমা দোজার বিরুদ্ধে আনীত প্রতিটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর তাকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৭(৯) মোতাবেক বিধিমালা ৪ (৩) (ঘ) অনুযায়ী গুরুদণ্ডস্বরূপ কেন চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না, তার দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে জবাব দিতে বলা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।
পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে নিয়ম অনুয়ায়ী চূড়ান্ত বরখাস্তের সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মতামত জানতে চায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। পিএসপি সচিব ড. মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত ২৭ মার্চ ২০২৫ তারিখে পাঠানো চিঠিতে তাকে ‘গুরুদণ্ডস্বরূপ চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যায়’ মর্মে সম্মতি দিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে এখন শুধু বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ হবে।
আ. দৈ./ কাশেম