বুধবার, ২ জুলাই ২০২৫,
১৮ আষাঢ় ১৪৩২
ই-পেপার

বুধবার, ২ জুলাই ২০২৫
জাতীয়
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র
নিজস্ব প্রতিবেদক
Publish: Tuesday, 1 July, 2025, 8:31 PM  (ভিজিট : 50)

গুম করে ভুক্তভোগীদের নির্যাতনের জন্য শব্দনিরোধক বিশেষ কক্ষ তৈরি করেছিল র‍্যাব। যাতে নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের কান্নার শব্দ বাইরে থেকে শোনা না যায়। ভুক্তভোগীদের ১০ ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনে শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হলে ওষুধ ও মলম দেওয়া হতো। এরপর শরীরের দাগ মুছলে তাঁদের জনসমক্ষে আসামি হিসেবে উপস্থাপন করা হতো।

এসব তথ্য উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে গুমসংক্রান্ত কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুম ও নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিক দিক উন্মোচন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গত বছরের ৫ আগস্টের আগে যে গুমের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, তার পদ্ধতিগত চর্চা উন্মোচনের চেষ্টা করে কমিশন। গুম করে মানুষকে গোপন বন্দিশালায় মাস ও বছরের পর বছর রাখা হতো। এসব ব্যক্তিকে নির্যাতনের জন্য আলাদা কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। এসব কক্ষ বিশেষ কায়দায় শব্দনিরোধক করে তৈরি করা হতো। নির্যাতনের জন্য সেখানে বৈদ্যুতিক শর্ট দেওয়ার চেয়ার, ঘূর্ণায়মান চেয়ার, হাত–পা বাঁধার বিশেষ রশি, নখ তুলে ফেলাসহ শারীরিক নির্যাতন করতে বিভিন্ন যন্ত্র রাখা হতো। এসব কক্ষ র‍্যাব ও ডিজিএফআই ব্যবহার করত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুক্তভোগীদের নির্যাতনের জন্য র‍্যাব-২–এ সিপিসি ৩–এ বৈদ্যুতিক ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টিএফআই সেলে মানুষকে ঝুলিয়ে রাখার জন্য পুলি–সিস্টেম এবং একাধিক স্থানে শব্দনিরোধক কক্ষ তৈরি করেছিল তারা।

গুমসংক্রান্ত কমিশন নির্যাতনের গুম হওয়া মানুষের ওপর চালানো নির্যাতনের ১০টি দিক তুলে ধরেছে প্রতিবেদনে। সেগুলো হলো—
সর্বব্যাপী অস্বস্তি সৃষ্টি করে রাখা হতো। এসব ব্যক্তিকে প্রহরীদের অর্ধেক খাবার দেওয়া হতো। নিজের ভাগ্যে কী ঘটবে, তিনি কিছুই জানতেন না। দীর্ঘ সময় মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতেন তাঁরা।

ছোট বন্দিশালায় যেখানে ঘুমাত, সেখানেই টয়লেটের ব্যবস্থা। টয়লেটে বসলেও সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করা হতো। বন্দিদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও অস্বস্তিকর ও ভীতিকর ছিল।

নারীদের জন্য গোপন বন্দিশালা ছিল আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি। নারীদের গুম করে অনেকটা ক্রুসিফাইডের মতো করে হাত দুই দিকে বেঁধে রাখা হতো। এভাবে শরীরে ওড়নাও রাখতে দিতো না তারা। নারীদের পিরিয়ডের সময় তাঁদের প্যাড দেওয়া হতো না। উল্টো পুরুষ প্রহরীরা এটা নিয়ে হাসাহাসি করতেন। ২০১৮ সালে ২৫ বছর বয়সী এক নারীকে গুম করে ২৪ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল। ওই নারীর বর্ণনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

অসংখ্য গুম হওয়া মানুষের নির্মম প্রহারের অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোপন বন্দিশালা থেকে ব্যক্তিদের নির্যাতনের জন্য শব্দনিরোধক কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে কখনো চোখে গামছা বেঁধে, কখনো যমটুপি পরিয়ে হাত ওপরে বেঁধে বেধড়ক পেটানো হতো।

২০২৩ সালে ডিএমপির সিটিটিসি ৪৭ বছরের এক ব্যক্তিকে গুম করে ১৪ দিন গোপন বন্দিশালায় রেখেছিল। ওই ভুক্তভোগী বলেন, ‘মারধরের সময় একাধিক লোক থাকত। দু-তিনজন মিলে পেটাত। মারতে মারতে বলত, তোর মাংস-হাড্ডি আলাদা করে ফেলব।’

নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের শরীরে একাধিক স্থায়ী আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে কমিশন। ২০১৭ সালের ২৩ বছরের এক যুবককে অপহরণ করে গুম করে র‍্যাব-১১-এর সদস্যরা। তাঁকে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে পা ওপরের দিকে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। তাঁর নাভীর দুপাশে নির্যাতনের এখনো দাগ রয়েছে।

ডিএমপির সিটিটিসিতে নির্যাতনের জন্য চারটি শিফট ভাগ করে নিতেন কর্মকর্তারা। ২০২২ সালে সিটিটিসি ৪৬ বছরের এক ব্যক্তিকে গুম করে ২৫৩ দিন আটকে রেখেছিল। তাঁকে টানা ২৪ ঘণ্টা নির্যাতন করা হয়। এ জন্য চারটি শিফটে সিটিটিসির কর্মকর্তারা ভাগ হয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর জবানবন্দিতে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

হাত ছাদের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে নির্যাতন, উল্টো করে বেঁধে নির্যাতন করতেন র‍্যাবের সদস্যরা। নির্যাতনের একটি কমন বিষয় ছিল নখ তুলে ফেলা। র‍্যাব সদস্যরা এই কাজ প্রায়ই করতেন। এ ছাড়াও নখের ভেতরে সুইচ ঢুকিয়ে দিতেন, বাঁশ দিয়ে নির্যাতন করতেন, বিশেষ চেয়ারে বসিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, ওয়াটারবেডিং অর্থাৎ মুখের ওপর গামছা দিয়ে ওপর থেকে পানি ছাড়া হতো। এ সময় তিন-চারজন টর্চার সেলের মেঝেতে হাত-পা দিয়ে চেপে ধরতেন। ভুক্তভোগীদের যৌন হয়রানি করা হতো। কেউ কেউ লজ্জায় কমিশনকে এই ঘটনা বলতে চাননি, তারপরও কয়েকজন বন্দী এ বিষয়ে মুখ খুলেছিলেন কমিশনের কাছে। বন্দীদের প্রসবের সময় বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম করে গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখায় অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অনেকের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যে। একজন তরুণকে ২০১৯ সালে গুম করে র‍্যাব-৩ ও গোয়েন্দা শাখা। তাঁকে ২০ মাস ১৩ দিন গুম করে রাখা হয়। র‍্যাবের নির্যাতনে তিনি এখন মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। একাকী হাসছেন, কথা বলছেন ও কাঁদছেন।

গুমসংক্রান্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, গুমের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ র‍্যাবের বিরুদ্ধে। তারা গুম করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গোপনে নির্যাতন করত। এ জন্য তাদের অনেক আয়োজন ছিল। নির্যাতনের পর আবার মেডিসিন দেওয়া হতো। যখন সুস্থ হতো, তখন একটি মামলা দিয়ে জনসমক্ষে আনা হতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ ৩৪৫ জন।

আ.দৈ/আরএস


   বিষয়:  গুম   কমিশনের   প্রতিবেদনে   নির্যাতনের   ভয়াবহ   চিত্র  
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ইসরায়েল- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে ইরানীদের মৃত্যুদণ্ডের আইন পাস
ডিএনসিসিতে পুনরায় নগর স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে
বিভেদ ভুলে এক হলেন হিরো আলম-রিয়ামনি
যতক্ষণ না দুঃখ প্রকাশ করছো, শান্তি পাবে না: আ. লীগকে শফিকুল আলম
৭১’র মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই ২৪’র বীর শহিদদেরও জাতি ভুলবে না: তারেক রহমান
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

ইবিতে আইনগত নারী ক্ষমতায়ন বিষয়ক পিএইচডি সেমিনার
ডিএনসিসিতে পুনরায় নগর স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে
নারায়ণগঞ্জে সাবেক বিএনপি নেতাকে মারধর, ভিডিও ভাইরাল
ইসলামি দলগুলো হবে আগামী দিনের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি: ইসলামী আন্দোলনের আমির
এইচএসসি কেন্দ্রে প্রকাশ্যে গুলি অভিযুক্ত গ্রেফতার ৩ পুলিশ আহত
জাতীয়- এর আরো খবর
close
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik$gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝