বাংলাদেশের জনগণের জন্য প্রতি কেজি ইলিশ মাছের খুচরা বিক্রয় মূল্য সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা নির্ধারণ চেয়ে আইনি নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী।
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) ডাকযোগে ও ই-মেইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের প্রধান নিয়ন্ত্রকের কাছে এ নোটিশ পাঠান আইনজীবী খন্দকার হাসান শাহরিয়ার।
নোটিশে আগামী ৭ দিনের মধ্যে ইলিশ মাছের পাইকারি ও খুচরা বাজার মনিটরিং করা, ইলিশ মাছ সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পাচাররোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোর বাস্তবতা মেনে ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে একটি অভিন্ন সময়ে বা কাছাকাছি সময়ে ইলিশ মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার বিষয়ে লিখিতভাবে ভারতকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়া হয়।
এছাড়া ভবিষ্যতে যেকোনো দেশে ইলিশ মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে যেন ইলিশ মাছ রপ্তানি করা না হয় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। অন্যথায় উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করা হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ মূলত বঙ্গোপসাগরের মাছ। মহান আল্লাহ প্রদত্ত এই ইলিশ মাছ বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের চেয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা অনেক বেশি বিস্তৃত। ভারত ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় প্রচুর ইলিশ মাছ উৎপাদন হয়। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন নদীতেও ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। এই ইলিশ মাছ সাগরের মাছ হলেও ডিম পাড়ার জন্য যখন ইলিশ পদ্মা নদীতে আসে, তখন ইলিশ মাছ পদ্মার বিভিন্ন প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে পরিপুষ্ট হয় এবং প্রাকৃতিকভাবে অত্যন্ত সুস্বাদু হয়ে উঠে।
মূলত পদ্মা নদীর ইলিশ মাছই স্বাদে ও গন্ধে উৎকৃষ্ট। ফলে পদ্মা নদীর ইলিশ মাছ যখন রান্না করা হয় তখন এর সুঘ্রাণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু ইলিশ মাছ সাগরের মাছ তাই এই মাছ পুকুরে বা অন্য কোনো স্থানে চাষ করতে হয় না। ফলে ইলিশের কোনো ধরনের উৎপাদন খরচ নেই। এটি শতভাগ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছ। বাংলাদেশে রুই, কাতলাসহ যেসব মাছ চাষ করা হয় তা বাজারে কেজি প্রতি সর্বোচ্চ ৫শ টাকাতে খুচরা বিক্রয় করা হয়। বাংলাদেশে ভারতীয় এজেন্টরা ও মাছ রপ্তানিকারকরা সারা বছর পদ্মা নদীর ইলিশ মাছ মজুদ করে রাখে। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে পদ্মা নদীর সব ইলিশ মাছ ভারতে রপ্তানি করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পাচার করে। বাংলাদেশের পদ্মা নদীর সব ইলিশ মাছ ভারতে রপ্তানি ও পাচার হওয়ার কারণে বাংলাদেশের জনগণ জাতীয় মাছ হওয়া সত্ত্বে বাজারে গিয়ে পদ্মা নদীর ইলিশ পায় না। ফলে বাংলাদেশের জনগণকে সামুদ্রিক ইলিশ খেতে হয়, যা পদ্মার ইলিশ মাছের মতো সুস্বাদু নয়।
বাংলাদেশে ইলিশ সুরক্ষায় ৩ মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এর মধ্যে অক্টোবরে ২২ দিন। এ সময় মা মাছের ডিম ছাড়ার সুযোগ দেয়া হয়। এরপর বাচ্চা হলে তার সুরক্ষায় ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল দুই মাস নিষেধাজ্ঞা থাকে। মাছের বাড়ানোর জন্য ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই আবার এক দফায় সাগরে নিষেধাজ্ঞা থাকে। অন্যদিকে ভারতে নিষেধাজ্ঞা থাকে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত। ১৫ জুন শুরু হয় তাদের মাছ ধরা। বাংলাদেশে ইলিশ মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার সুবিধা পাচ্ছেন ভারতের মৎস্যজীবীরা। এক মাসের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে চলা নিষেধাজ্ঞার সময় ভারতে ব্যাপকভাবে ইলিশ মাছ ধরা হয়। এতে বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে বেশি ইলিশ মাছ ধরা পড়ে। সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোর বাস্তবতা মেনে ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে একটি অভিন্ন সময়ে বা কাছাকাছি সময়ে ইলিশ মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা তাই অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এই বিষয় নিয়ে এখনো ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি বাংলাদেশ। নোটিশ প্রাপকদের দায়িত্বে অবহেলার ফলে বাংলাদেশের জনগণ কম দামে বড় আকারের সুস্বাদু পদ্মার ইলিশ মাছ তথা জাতীয় মাছ খাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
নোটিশে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলোতে জাতীয় মাছ ইলিশের দাম বাংলাদেশের জনগণের ক্রয়সীমার বাইরে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারিত হওয়ার পর ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার কারওয়ান বাজারে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে অভিযান পরিচালনা করে। সেই সময় হঠাৎ করেই অভিযান পরিচালনার স্থানে দাম কমে যায় ইলিশ মাছের। অথচ জাতীয় মাছ ইলিশ নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ করে এক শ্রেণির মৎস্য ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে মনোপলি কর্মকাণ্ড করলেও নোটিশ প্রাপকরা প্রতি কেজি ইলিশের সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে বাংলাদেশের জনগণকে সুলভে জাতীয় মাছ ইলিশ খাওয়ানোর ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেননি।
নোটিশে আইনজীবী খন্দকার হাসান শাহরিয়ার আরও বলেছেন, বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রতি কেজি ইলিশ ১০ মার্কিন ডলার বা ১ হাজার ১৮০ টাকা দরে রপ্তানি শুরু হয়েছে।
ভারতে যেই দামে ইলিশ মাছ রপ্তানি হচ্ছে, তার চেয়ে প্রতি কেজিতে কমপক্ষে ৯শ টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে বাংলাদেশের ভোক্তাদের। ইলিশ রপ্তানির পরিপত্রটি কয়েক বছর আগে তৈরি করা। এছাড়া বাংলাদেশের রপ্তানি নীতি ২০২১-২৪ অনুযায়ী, ইলিশ মাছ মুক্তভাবে রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য নয়। এই মাছ রপ্তানি করতে চাইলে যথাযথ শর্ত পূরণ করতে হবে। তাই ইলিশ মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশীয় বাজারদরের চেয়ে বেশি মূল্যে রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করা উচিত ছিল।
বাংলাদেশের জনগণ যেখানে প্রতি কেজি ইলিশ মাছ ১৯০০-২৪০০ টাকায় খুচরা বাজারে কিনছে সেখানে ভারতে রপ্তানি মূল্য কীভাবে ১১৮০ টাকা হতে পারে? এর ফলে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এই ক্ষেত্রে নোটিশ প্রাপকরা চরম দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের ক্ষতিসাধন করেছেন বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
আ.দৈ/এআর