জ্বালানির উচ্চমূল্য ও অতিরিক্ত মাশুলের চাপের মধ্যে থাকা দেশের বেসামরিক বিমান চলাচল খাতের অন্যতম কোম্পানি নভোএয়ারও শেষ পর্যন্ত বন্ধ হতে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার গুঞ্জনের মধ্যে গতকাল শুক্রবার (২ মে) ফ্লাইট চলাচল ‘সাময়িকভাবে’ বন্ধ ঘোষণা করে বেসরকারি এয়ারলাইন্সটি।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্রে জানা গেছে, দুই সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় ফ্লাইট পরিচালনা করবে জানিয়ে ২ মে থেকে নভোএয়ার সাময়িকভাবে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ রেখেছে। মূলত বিক্রয় প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ফ্লাইট চলাচল সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে।
নভোএয়ারের রিজার্ভেশন বিভাগ জানায়, যেসব যাত্রী সংস্থার কাছ থেকে সরাসরি টিকিট কেটেছেন, তাঁরা অফিসে যোগাযোগ করে অর্থ ফেরত নিতে পারবেন। আর যারা এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট কিনেছেন, তাঁদেরকে সংশ্লিষ্ট এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
নভোএয়ারের সাময়িক উড্ডয়ন বন্ধের মাধ্যমে আবারো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, দেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্স খাত কতটা সংকটে আছে। দেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, জিএমজি এয়ারলাইন্স, রিজেন্ট এয়ারওয়েজসহ বেশ কয়েকটি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। নভোএয়ার এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বন্ধ’ ঘোষণা না করা হলেও বিষয়টি সেদিকেই গড়াচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
একাধিক সূত্র জানিয়েছেচলমান আর্থিক সংকটের কারণে হঠাৎ করেই সব ধরনের ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে দিয়েছে নভোএয়ার। অভ্যন্তরীণ রুটে নির্ভরযোগ্য সেবার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানটির এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া শুধু কোম্পানির সমস্যা নয়, বরং দেশের পুরো এভিয়েশন খাতের।
নভোএয়ারের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নভোএয়ার বিক্রির উদ্দেশ্যে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। সেই আলোচনার অংশ হিসেবে কোম্পানির উড়োজাহাজসহ অন্যান্য সম্পদের নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। বিক্রির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। বিক্রির চেষ্টা সফল না হলে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা আছে মালিকপক্ষের।
বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর সংকট একদিনে তৈরি হয়নি। নভোএয়ারের মতো অনেক এয়ারলাইনসই এক সময় বড় স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, অতিরিক্ত সারচার্জ, সরকারের নীতিগত সহায়তার অভাব এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার কৌশলগত দুর্বলতা এ খাতকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। গত ২৮ বছরে এক ডজনের বেশি দেশীয় এয়ারলাইনস দেউলিয়া হয়ে গেছে। অ্যারো বেঙ্গল, এয়ার বাংলাদেশ, জিএমজি এয়ারলাইনস, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, রিজেন্ট এয়ারওয়েজসহ অনেক এয়ারলাইনসই বন্ধ হয়ে গেছে।
দেশি এয়ারলাইন্সগুলোর অন্যতম প্রধান সংকট হলো অ্যাভিয়েশন ফুয়েল বা বিমান জ্বালানির অস্বাভাবিক দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশে বিমান জ্বালানির মূল্য তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি রাখা হচ্ছে। এই উচ্চ জ্বালানি ব্যয়ের কারণে অপারেটিং কস্ট বেড়ে গিয়ে লাভজনকতা নষ্ট হচ্ছে, যা বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
দেশি বিমান সংস্থাগুলোর জন্য আরও একটি বড় চাপ হচ্ছে— সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স, ভ্যাট ও ফি। প্রতি ফ্লাইটে কর পরিশোধ করতে হচ্ছে অনেক স্তরে, যার মধ্যে রয়েছে এয়ারপোর্ট চার্জ, রোড নেভিগেশন ফি, সিভিল এভিয়েশন সারচার্জ ইত্যাদি। এই অতিরিক্ত মাশুল বিদেশি এয়ারলাইন্সের তুলনায় দেশি এয়ারলাইন্সগুলোর প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার একটি বড় কারণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর আরেকটি বড় বাধা বেবিচকের নীতিমালা। যেমন— অনেক দেশে বকেয়া বিলের ওপর ৮ থেকে ১২ শতাংশ সারচার্জ আদায় করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা ৭২ শতাংশ। এর ফলে এয়ারলাইনসগুলো দেনার ভারে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নীতিনির্ধারণে দেশি এয়ারলাইন্সের কথা শুনছে না সরকার। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোকে রুট, স্লট ও অন্যান্য সুবিধায় অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। অথচ দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকার মতো সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে না। এতে করে স্থানীয় এভিয়েশন খাত হুমকির মুখে পড়ছে।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের এয়ারলাইনসের বাজারের দেশি কোম্পানির শেয়ার মাত্র ২২ থেকে ২৫ শতাংশ। বাকিটা বিদেশি এয়ারলাইনসের দখলে। এ অবস্থায় দেশের একটি এয়ারলাইনস বন্ধ হওয়া মানে দেশের এভিয়েশন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। এই তালিকা বড় হলে পুরো খাতই ধ্বংস হয়ে যাবে।