সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বহুল আলোচিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রভাবশালী সাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল, ওয়ান ইলেভেনের গডফাদার সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও সাবেক এমপি মাসুদ উদ্দীন চেীধুরী, ব্যবসায়ী নুরআলী এবং সাবেক এমপি বেনজির আহমেদের মালিনাধীন রিক্রুটিং এজেন্সিসহ ১২ টি এজেন্সির ৩২ জনের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট করে সাধারণ শ্রমিকদের পকেট কেটে ১ হাজার১২৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে পৃথক ১২টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আজ মঙ্গলবার (১১ মার্চ) দুদকের পক্ষ দায়ের করা পৃথক ১২ মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে সাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল, সাবেক এমপি মাসুদ উদ্দীন চেীধুরী ও সাবেক এমপি বেনজির আহমেদের মালিনাধীন রিক্রুটিং এজেন্সিসহ প্রভাবশালী ১২টি রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়ে গঠিত সিন্ডিকেটটি নানা কৌশলে মালয়েশিয়াগামী সাধারণ শ্রমিকদের জিম্মি করে সরকারের নির্ধারিত ‘ফি ও অর্থের’ ৫গুন বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিএমইটি ও বায়রার রেজিস্ট্রেশনের শর্তে সরকার নির্ধারিত প্রতি শ্রমিকের কাছ থেকে নেয়ার কথা মাত্র ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু তারা এর চেয়ে ৫ গুণ অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করেছেন। বলতে গেলে শ্রমিকদের পকেট কেটেছেন তারা। এই সিন্ডিক মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে বাংলাদেশ থেকে ৬৭ হাজার শ্রমিকের কাছ থেকে সরকারের নির্ধারিত অর্থের ৫ গুণ বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তারা ৬৭ হাজার শ্রমিকের কাছ থেকে ১ হাজার ১২৮ কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছেন এবং ওই অর্থ আত্মসাতের পাশাপিাশ মানিলন্ডারিং করেছেন। যা দুদকের অনুসন্দানে তথ্য প্রমাণ হাতে এসেছে।
এদিকে আজ মঙ্গলবার (১১ মার্চ) গণমাধ্যমকে তথ্য নিশ্চিত করেছেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার নিয়ে গঠিত ১২ এজেন্সির সিন্ডিকেট,সাবেক অর্থমন্ত্রীর এজেন্সিসহ ১২ টি ৩২ জনের বিরুদ্ধে ১২ দুদকের মামলা দায়ের করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে সরকার নির্ধারিত অর্থের চেয়ে ৫ গুণ বেশি অর্থ আদায় করে ১ হাজার ১২৮ কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে ১২টি রিক্রুটিং এজেন্সির ৩২ জনের নামে মামলা করা হয়েছে।
নিম্মে ১২ মামলায় ১২ প্রতিষ্ঠানের ৩২ আসামির পরিচয় তুলে ধরা হলো;
প্রথম মামলায়- আসামিরা হলেন-মেসার্স ওরবিটাল এন্টার প্রাইজের মালিক আ হ ম মোস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল ও তার স্ত্রী কাশমিরি কামাল। এই প্রতিষ্ঠানটি ৬ হাজার ২৯ কর্মীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ১০০ কোটি ৯৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা নিয়েছে। দ্বিতীয় মামলায়-আর আ হ ম মোস্তফা কামাল ও তার মেয়ে নাফিসা কামালের আরেক প্রতিষ্ঠান ‘ওরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল’ অর্থ আত্মসাৎ করেছে। তারাও পৃথক আসামি হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান ২ হাজার ৯৯৫ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ৫০ কোটি ১৬ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করে।
তৃতীয় মামলায় - রিক্রুটিং এজেন্সি-‘স্নিগ্ধা ওভারিসিজের’ মালিক ফেনী-২ আসনের সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, তার স্ত্রী নুরজাহান বেগম,এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শেখ আব্দুল্লাহ, জাহাঙ্গীর আলম, এম. আমিরুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন ও জিয়াউর রহমান ভুঁইয়াকে আসামি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ৬ হাজার ৬৫৭ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ১১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা বেশি আদায় করেছে।
চতুর্থ মামলায় - ‘বিনিময় ইন্টারন্যাশনালের’ মালিক আবদুস সোবহান ভুঁইয়া (চৌদ্দগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান) ও তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তারকে আসামি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ৫ হাজার ৪৫৮ ব্যক্তির কাছ থেকে ৯১ কোটি ৪২ লাখ টাকার অর্থ বেশি আদায় করেছে।
পঞ্চম মামলায় - ‘ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী, ওয়ান ইলেভেনের গডফাদার ও ফেনী ৩ আসনের এমপি লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী তার মেয়ে তাসনিয়া মাসুদ, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল মুকিত, মেহবুবা আফতাব সাথিকে আসামি হয়েছেন। তারা ৭ হাজার ১২৪ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ১১৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা বেশি অর্থ আদায় করেছেন।
ষষ্ঠ মামলায় -‘মেসার্স ইউনিক ইস্টার্ন (প্রাঃ) লি. এর মালিক নুর আলী ও তার স্ত্রী সেলিনা আলী ও মেয়ে নাবিলা আলী ছাড়াও আসামি হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন আহমেদ ও খোন্দকার শওকত হোসেন। প্রতিষ্ঠানটি ৩ হাজার ৭৮৮ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ৬৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছে।
সপ্তম মামলায় -‘ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল লি.’র’ মালিক মোহাম্মদ রুহুল আমিন ও তার স্ত্রী লুৎফুর নেছা শেলী মামলায় আসামি হয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি ৭ হাজার ৭৮৭ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ১৩০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছে। থেকে ১৪৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে।
অষ্টম মামলায় -‘মেসার্স আহমদ ইন্টারন্যাশনালের মালিক , ঢাকা ২০ আসনের সাবেক এমপি বেনজীর আহমদ আসামি হয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি ৮ হাজার ৫৯২ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ১৪৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে।
নবম মামলায় -‘বি এম ট্রাভেলস লি’র মালিক ,বাড্ডার সাবেক কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মৌসুমি আক্তার আসামি হয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি ৮ হাজার ৯৩ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ১৩৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছে।
দশম মামলায়--‘বি এন এস ওভারসিজ লি.র’ মালিক ও যুবলীগ নেতা আবুল বাশারের ছেলে ইঞ্জি. ইশতিয়াক আহমেদ সৈকত, এবং সৈকতের স্ত্রী মিসেস নসরুন নেছা হয়েছেন আসামি। প্রতিষ্ঠানটি ৪ হাজার ২১৫ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ৭০ কোটি ৬০ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছে।
একাদশ মামলায় -‘রুবেল বাংলাদেশের’ মালিক মুহাম্মাদ মজিবুল হক রুবেল ও তার স্ত্রী কামরুন নাহার হীরামনি আসামি হয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি ২ হাজার ৮৪৫ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ৪৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছে। দ্বাদশ মামলায়- ‘দি ইফতী ওভারসিজের’ মালিক রুবেল ও বোরহান উদ্দিন (পান্না)কে আসামি হয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি ৩ হাজার ৭৯৭ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ৬৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছে।
দুদকের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, অভিযুক্তরা পরস্পর যোগসাজশে, অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তারা সাবেক মন্ত্রী,এমপি,উপজেলার চেয়ারম্যান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলার। তারা রাজনৈতিক ও সরকারের ক্ষমতাবান হিসাবে দায়িত্বপালনকালে, প্রভাব খাঁটিয়ে বায়রার বিভিন্ন পদের দায়িত্ব নিজেরা পালন করেছেন। সেইসুবাধে তারা সিন্ডিকেট করে বিএমইটি ও বায়রার রেজিস্ট্রেশনের শর্ত ভঙ্গ করে সরকার নির্ধারিত প্রতি শ্রমিকের কাছ থেকে মাত্র ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার চেয়ে ৫ গুণ অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করেছেন।
মালয়েশিয়া শ্রমিক রিক্রুটের জন্য এজেন্ট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে রিক্রুটেড শ্রমিকদের অবৈধভাবে ক্ষতিসাধন করে বিভিন্ন ধাপে বাড়তি অর্থ গ্রহণের করেছে আসামিরা। প্রভাব খাটিয়ে চুক্তিবদ্ধ আইনসংগত পারিশ্রমিক ব্যতীত এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক কর্মকাণ্ড না করে পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে অবৈধ পারিতোষিক গ্রহণ করে মালয়েশিয়ায় প্রেরিত কর্মীর কাছ থেকে পাসপোর্ট, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং প্রতি কর্মীর কাছ থেকে নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণপূর্বক আত্মসাৎ করেছেন।
আ. দৈ./ কাশেম