ফাইল ছবি
ছাত্র জনতার অভ্যূত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগসেন্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন শেখ হাসিনা। তার সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের দেশে আর্থিক ব্যবস্থা একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অনুগত ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার শাসকদের দোসরারা ইচ্ছামতো ব্যাংকের লুটপাট চালিয়েছে। নামে বেনামে কোম্পানি করে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে বিদেশে পাচার করেছেন।
কিন্তু ৫ আগস্টের পটপরিবর্তের শেখ হাসিনার দোসররা এখনো ব্যাংকে বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। আওয়ামী পরিচালকদের নিয়ে নিয়মিত বোর্ড মিটিং করে যাচ্ছেন সোনালী এমডি। এখনো ইচ্ছামতো লোন অনুমোদন আওয়ামী ব্যাসায়ীদের আর্থিক সুবিধা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে গত ৮ আগস্ট। এর পর সচিবালয়, পুলিশ প্রশানসহ নানা ক্ষেত্রে রদবদল আনা হলেও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এখনো আগের মতো রয়েছে গেছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যংকের গর্ভনর হিসেবে নতুন দায়িত্ব নিয়েছে ড. আহসান এইচ মনসুর। কিন্তু এখনো ব্যাংক খাতের লুটপাট থামেনি। আগের সরকারের অনুগত হয়ে এসব এমডিরা দায়িত্ব নিলেও এখনো রাষ্টয়াত্ব এসব ব্যাংকে কোন পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে এসব এমডি ও পরিচালনা পর্ষদ রেখে ব্যাংক খাতে কতটা পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন লুটপাটকারী আওয়ামী দোসর দিয়ে এখন এসব ব্যাংক পরিচালনা করা হলে কোন পরিবর্তন আসবে না।
এখন তার বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও তাদের দোসরদেও হাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দখল রয়েছে। ফলে সরকার ব্যাংক খাতের যতই সংস্কারের চেষ্টা করুন না কেন কোন সুফল বয়ে আসবে না। সুফল পেতে হলেও এখনি তাদের এমডির পদ থেকে অপসারণ করতে হবে। পাশাপশি আওয়ামী পরিচালকদের সরিয়ে নতুন করে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করতে হবে। তারা বলেন, আওয়ামী দোসরদের রেখে ব্যাংকগুলোতে আর্থিক শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না।
এদিকে জানা গেছে কর্মকর্তা কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দকী। মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। পদত্যাগে দাবিতে সোমবার তাকে সোনালী ব্যাংকে অবরুদ্ধ করে রাখেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা। এদিন রাতে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। আদেশের কপি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর। একটি শিল্প গ্রæপের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতার জেরে তাকে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয় বলে গুঞ্জন ছিল।
কিন্তু অন্যরা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে গেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংকগুলোতে ব্যবস্থপানা পরিচালক ব্যাংক ধ্বংসের কারিকর হিসেবে ভুমিকা পালন করেছেন। তারা এখনো স্বস্ব পদে বসে আছেন। অথচ দেশে ব্যবসায়ী সমাজ এইসব ব্যাংক লুটেরাদের শাস্তির দাবী জানিয়েছেন। তারা অর্থপাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানিয়েছেন। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে আলোচনা শেষে এ কথা জানান ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই নেতারা।
বৈঠক শেষে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু সাংবাদিকদের বলেন, যারা অন্যায়ভাবে সম্পদ লুট করেছে, অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জন করেছে এবং যারা ব্যাংকগুলো লুট করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গভর্নরকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। যারা ব্যবসার নাম করে লুটপাটে জড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষে ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমরা দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে। লুটপাট-পাচারের বিরুদ্ধে। ডলারের বিনিময়হার ওঠা-নামার কারণে লোকসানে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। এটা নিয়ন্ত্রণের অনুরোধ করা হয়েছে। অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের বিষয় বলা হয়েছে আমাদের পক্ষ থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতি ঠিক রাখতে কাজ করবে। সরকারের সব ভালো পদক্ষেপ এবং দেশের উন্নয়নে ব্যবসায়ীরা পাশে থাকবে। তারা আরও বলেন, বিগত সরকারের ব্যাংকিং নীতিগুলো সঠিক ছিল না, সেগুলো সংশোধন করতে হবে। বিনিয়োগ বান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। তারা জানান গর্ভনর বলেছেন, আগামী ৬-৭ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। যারা দুর্বৃত্তায়ন করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে থাকবে ব্যবসায়ীরা।
তবে জানা গেছে ব্যাংক এই পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেপুটি গভর্নরের শূন্য পদে নিয়োগ পেতে দৌঁড়-ঝাপ করছেন এস আলম ঘনিষ্ঠরা। এতদিন নানা উপায়ে গ্রæপটিকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কাজ করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কারও-কারও নাম আলোচনায় আসায় নতুন করে অস্থিরতার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতা বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া না হলে তারা বিক্ষোভ করবেন বলে জানা গেছে। সরকার পতনের পর গত ৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে এস আলম ঘনিষ্ঠ গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের পদত্যাগের দাবিতে নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়। এরপর আব্দুর রউফ তালুকদার পলাতক অবস্থায় পদত্যাগ করেছেন।
ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, খুরশীদ আলম, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস ও নীতি উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাছের পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। জানা গেছে ডেপুটি গভর্নরের শূন্য পদে নিয়োগ দিতে সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীকে আহবায়ক করে চার সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সার্চ কমিটি গত সোমবার বৈঠক করে কয়েকজনের নামে সুপারিশের জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে। এ তালিকায় এস আলম ঘনিষ্ঠ নির্বাহী পরিচালকের নাম রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সার্চ কমিটির সদস্যদের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় সূত্রে কারও-কারও নাম আলোচনায় এসেছে। এস আলম ঘনিষ্ঠ কেউ ডেপুটি গভর্নর হলে তারা তা মেনে নিবেন না। কেননা, এস আলম ঘনিষ্ঠদের রেখে ব্যাংক খাত কলঙ্কমুক্ত করা সম্ভব না।
ব্যাংকাররা জানান, বিভিন্ন ব্যাংক দখলে নিয়ে নামে-বেনামে বিপুল অংকের অর্থ বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এজন্য বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দিয়ে ব্যাংক খাতে বড় একটি চক্র গড়ে তোলেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার নানা উপায়ে তাকে সহায়তা করেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকজন ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক, পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা নানা সুবিধা নিয়ে তার পক্ষে কাজ করেন। গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর পদত্যাগ করলেও এস আলম ঘনিষ্ঠ নির্বাহী পরিচালকসহ অন্যরা বহাল তবিয়তে আছেন। এখন তারা ডেপুটি গভর্নর হওয়ার জন্য দৌঁড়-ঝাপ করছেন।
আ. দৈনিক / কাশেম