বাংলাদেশের ইতিহাসে ব্যাংকিং সেক্টারে নজিরবিহীন লোপাট, বিদেশে অর্থপাচার, বিপুল পরিমান অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী ও চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ সাবেক মন্ত্রী, এমপি এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম আলোচিত আপদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত ফরিদপুরের প্রভাবশালী সাবেক এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরীর পরিবারটি। অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিক্সন চৌধুরী ও তার স্ত্রী তারিন হোসেনের ব্যাংক হিসাবে তিন হাজার ১৬২ কোটি টাকা অস্বাভাবিক লেনদেন এবং প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পৃথক দুইটি মামলা দায়ের করেছে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ত্বাধীন ফ্যাসিস্ট সরকারের টানা ১৫ বছরের এই দেশে আর্থিক সেক্টরে নজিরবিহীন লোপাট ও বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার পাচার হয়েছে। ওই আর্থিক সেক্টরে লোপাট ও বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার পাচারকারীদের শীর্ষস্থানে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী।আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব তথ্য বেরিয়ে আসছে।
নিক্সন চৌধুরী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আত্মীয়তার সুযোগে ওই এলাকায় ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করেন। বিভিন্ন সময় বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত ছিলেন। পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার সময়ে তার নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে লাপাত্তা তিনি।
বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে নিক্সন চৌধুরী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ ও মানিলন্ডারিংএর সুনিদিষ্ট অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা,; দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২ ও ৩) ধারায় মামলা দুটি দায়ের করা হয়েছে। এই মামলার বাদী দুদকের সহকারী পরিচালক মো. ফেরদৌস রহমান।
বিকেলে গণমাধ্যমকে সাবেক এমপি নিক্সন চৌধুরী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন। তিনি আরো জানান, প্রথম মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে নিক্সন চৌধুরী সংসদ সদস্য পদে দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১১ কোটি ২৩ লাখ ৬২ হাজার ৪৩৫ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে নিজের দখলে রেখেছেন। এ ছাড়া তার নিজের ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ৫৫টি ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে মোট এক হাজার ৪০২ কোটি ৫১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৯১ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন করেছেন। যার মাধ্যমে মূলত অপরাধলব্ধ অবৈধ অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন তিনি। এই অপরাধে সাবেক এমপিনিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. ফেরদৌস রহমান।
দুদকের মহাপরিচালক বলেন, দুদকের পক্ষ দ্বিতীয় মামলায় আসামি করা হয়েছে নিক্সন চৌধুরীর স্ত্রী তারিন হোসেনকে। মামলায় উল্লেখ করা হয়েচেন, তিনি স্বামী নিক্সন চৌধুরীর সহযোগী। মিসেস তারিন হোসেন তার স্বামীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ৮ কোটি ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭০৮ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। একই সঙ্গে তিনি তার নিজ নামীয় ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ১৭টি ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে মোট এক হাজার ৭৬০ কোটি ৩৪ লাখ ৫১ হাজার ৩২০ টাকা অস্বাভাবিক লেনদেন করেছেন। অবৈধ অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে আড়াল করতে ওই হিসাবগুলো ব্যবহার করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে।
দুদকের পক্ষ থেকে সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শিহাব সালামবাদী হয়েছ অভিযুক্ত তারিন হোসেনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ ও মানিলন্ডারিং করার সুনিদষ্ট অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা; দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২ ও ৩) ধারায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
সূত্র মতে, এরআগে সাবেক এমপি নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগ অনুসন্ধানেরজন্য দুদকের উপ পরিচালক মো. সালাহউদ্দীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়। পরে দুদকের এই টিমের পক্ষ থেকে করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ অক্টোবর নিক্সন চৌধুরী ও তার স্ত্রী তারিন হোসেনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।
অভিযোগ রয়েছে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন নিক্সন চৌধুরী। নিজ ও পরিবারের নামে হাজার বিঘার বেশি ভূমি রয়েছে। ঢাকার পূর্বাচল, আদাবর, গুলশান ও বনানীতে প্লট ও ফ্ল্যাট রয়েছে। সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় রয়েছে বাড়ি। ফরিদপুরে নিজের বাড়িতে বানিয়েছেন আস্ত একটা চিড়িয়াখানাও।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আড়িয়াল খাঁ নদ ও পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি করে হাজার-হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন নিক্সন চৌধুরী। আশপাশের জমির মালিকদের ডেকে বাড়িতে এনে জোর করে ভাঙ্গার সদরপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে পাঠিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। এভাবে প্রায় ১১শ বিঘা জমি নিজের স্ত্রী ও সন্তান এবং ভাইয়ের নামে দলিল করে নিয়েছেন তিনি।
আ. দৈ. /কাশেম