বন্দর নগরী চট্টগ্রামে রাজনৈতিক বিরোধ,আধিপত্য বিস্তার,চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে সংঘর্ষ এবং খুনের ঘটনা বেড়েই চলছে।গত এক বছরে চট্টগ্রামে অন্তত ৩৬টি হত্যাকান্ড হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি খুন হয়েছে রাউজানে। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের হলের আসামি গ্রেপ্তার নেই বললেই চলে।
সর্বশেষ আজ শনিবার (২৫ অক্টোবর) বিকেল সোয়া ৪টার দিকে পৌরসভার নয় নম্বর ওয়াডে চট্টগ্রামের রাউজানে প্রতিপক্ষের গুলিতে যুবদলের কর্মীর আলমগীর ওরফে আলম (৫৫) মারা যায়। গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া।
ওসি মনিরুল বলেন, ‘ যুবদল কর্মীকে হত্যার খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে পুলিশ গেছে। সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে গেপ্তারের চেষ্টা করছে পুলিশ। আসামি ধরতে অভিযান চলছে।’ তিনি বলেন, যুবদল কর্মী আলমগীর প্রতিপক্ষের গুলিতে মৃত্যুর বিষয়ে পুলিশ তদন্ত করে বিস্তারিত জানাবে।
এদিকে স্থানীয় লোকজন গণমাধ্যমকে জানান, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি, দখলসহ বিভিন্ন কারণে এসব হত্যার ঘটনা ঘটে। তবে এর মধ্যে বেশির ভাগই ছিল রাজনৈতিক। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে যেমন খুন হয়েছে, তেমনই প্রতিপক্ষের হাতে আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মী ও ক্যাডারও খুন হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরী ছাড়াও জেলার রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ভূজপুর, ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড ও সাতকানিয়ায় এসব অপরাধ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৬টি খুন হয়েছে রাউজানে। এদিকে প্রায় প্রতিটি হত্যার ঘটনায় মামলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামি ধরা পড়ছে না।
এরআগে মঙ্গলবার হাটহাজারীর ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপি কর্মী আবদুল হাকিমকে। রাউজানের এই বাসিন্দাকে হত্যার পেছনেও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে পদ স্থগিত) গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন, তার এই অনুসারীকে পেশাদার খুনিরা হত্যা করেছে। তাদের নিশ্চয়ই কেউ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।
রাউজানে গত বছরের ২৮ আগস্ট প্রথম খুনের ঘটনা ঘটে। ওইদিন বিকালে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী মার্কেট এলাকায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নের শ্রমিক লীগ নেতা আবদুল মান্নানকে। গত বছর ১ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ-সদস্য ফজলে করিম চৌধুরীর বাগানবাড়ি থেকে মো. ইউসুফ মিয়া নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১১ নভেম্বর নিখোঁজের ৩ দিনের মাথায় রক্তাক্ত অবস্থায় হাফেজ মাওলানা আবু তাহের নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি উপজেলার নোয়াপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন নগরীর খাতুনগঞ্জের আড়তদার মো. জাহাঙ্গীর আলম। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মুহাম্মদ হাসান নামে এক যুবলীগ কর্মীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা।
গত ১৫ মার্চ ইফতার মাহফিল নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের মারধর ও ছুরিকাঘাতে খুন হন কমর উদ্দিন জিতু নামে এক যুবদল কর্মী। গত ২১ মার্চ পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের হোয়ারাপাড়া এলাকার মোবারক খালের পূর্ব পাশে খোলা জমি থেকে মো. রুবেল নামে এক তরুণের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।
গত ১৯ এপ্রিল রাতে খুন হন যুবদল কর্মী মানিক আবদুল্লাহ। ১৫ জন মুখোশধারী সন্ত্রাসী এসে ভাত খাওয়া অবস্থায় তার মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে হত্যা করে। গত ২২ এপ্রিল রাউজান উপজেলা সদরের কাছে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে গাজিপাড়া গ্রামে খুন হন ইব্রাহিম নামের এক যুবদল কর্মী। রাউজানে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৯টি মামলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামি গ্রেফতার হয়নি বলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানিয়েছে। দুটি খুনের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়নি পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে।
গত এক বছরে উত্তর জেলার ফটিকছড়ি ও ভূজপুরে ১০টি হত্যা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৮ মার্চ শান্তিরহাটে আধিপত্য বিস্তার ও মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের ঘটনায় রমজান আলী নামে এক যুবদলকর্মী প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হন।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নিউ দাঁতমারা চা বাগানের ভেতরে থেকে নিখোঁজের দুইদিন পর অটোচালাক বেলাল উদ্দিনের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ১ ফেব্রুয়ারি দাঁতমারা ইউনিয়নের বড় বেতুয়ায় মো. শহীদ নামে এক বিএনপিকর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গত ৯ জানুয়ারি বাগানবাজারে বালু উত্তোলনে বাধা দেওয়ার জেরে দুলায়েত হোসেন দুলালকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তিনিও বিএনপির সমর্থক।
এছাড়াও ভূজপুর থানা এলাকায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন্তানের হাতে গত ৬ এপ্রিল জুলেখা খাতুন নামে এক বৃদ্ধা নিহত হন। গত ৩ এপ্রিল মাসুম নামে এক যুবদল কর্মী প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন। একই দিন জঙ্গল হারুয়ালছড়ি গ্রামের সুরণ রায়ের ছেলে তর্ম রায় বন্ধুদের দায়ের কোপে নিহত হন।
সীতাকুণ্ডে এক মাসে চারটি রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ শনিবার ভোরে স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপ ইয়াসিন বাহিনীর সঙ্গে রোকন-গফুর বাহিনীর সংঘর্ষে খলিলুর রহমান কানু নামে একজন নিহত হন। গত ২ জানুয়ারি মীর আরমান হোসেন রানা নামের এক শ্রমিক দলের নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মীর আরমান সলিমপুর ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সভাপতি। এর আগে আরও দুইজনকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
নগরীতে তিনটি রাজনৈতিক হত্যা সংঘটিত হয়। গত বছরের ২৮ অক্টোবর নগরীর ডবলমুরিং থানা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জেরে খুন হন বাস্তুহারা ইউনিট কমিটি বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নূর আলম। গত ১০ অক্টোবর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকার বার্মা কলোনিতে মো. সবুজ ও শান্তিনগর কলোনির মো. শাহ আলমের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে বিএনপি কর্মী মো. ইমন নিহত হন।
গত ৪ মার্চ সাতকানিয়ায় সালিশের জন্য ডেকে নিয়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ‘মব জাস্টিস’ তৈরি করে জামায়াতের দুই কর্মী নেজাম ও আবু ছালেককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া সাতকানিয়ায় দেলোয়ার হোসেন নামে এক যুবলীগ কর্মীকে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শিল্পাঞ্চল ও ডিবি) রাসেল গণমাধ্যমকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। পুলিশের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতা ও স্থানীয় লোকজনকেও এগিয়ে আসা উচিত। অপরাধীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সব সময় সক্রিয়। বিভিন্ন হত্যা মামলায় আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। রাউজানে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
আ. দৈ./ কাশেম