বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচন সবসময়ই ক্রীড়া মহল ও সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের নজর কাড়ে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে উত্তেজনা তো থাকেই, সাথে যোগ হয় নানা জটিলতা ও বিতর্ক।
এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে একদিকে আইনি জটিলতা, অন্যদিকে প্রক্রিয়াগত অনিয়মের অভিযোগে বাড়ছে অনিশ্চয়তা। ক্রিকেটপ্রেমী থেকে শুরু করে ক্রীড়া সংগঠক, সাবেক কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়দের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেও প্রক্রিয়া, প্রার্থী বাছাই এবং ভোটাধিকার নিয়ে নানা অনিয়ম—অভিযোগ সামনে আসছে। ফলে নির্বাচনকে ঘিরে এক ধরনের দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েন বিরাজ করছে।
ক্রীড়া মহলের অনেকে অভিযোগ করছেন, বোর্ড পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকায় নির্বাচনও প্রভাবিত হচ্ছে। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে প্রার্থী বাছাই ও ভোটার তালিকায় প্রভাব বিস্তার করছেন বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে ন্যায়সঙ্গত প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের একটি বড় অংশ চাইছে আগের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আবারও নেতৃত্বে আসতে। এতে ভিন্ন মতাদর্শী অংশ নিজেদের বঞ্চিত বোধ করছে।
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি— থাকলে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটির নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্বাচন যদি বিতর্কিত হয়, তবে তার প্রভাব মাঠের ক্রিকেটেও পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কাউন্সিলর তালিকা ঘিরে জটিলতা
নির্বাচনের জন্য কাউন্সিলরদের নাম জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল গত ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টা। নিয়ম অনুযায়ী, ওই সময়ের মধ্যেই খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময়সীমা শেষ হওয়ার পরও তালিকা প্রকাশ হয়নি। বরং রাত পেরিয়ে পরদিন সকালেও খসড়া তালিকা অনুপস্থিত ছিল। এ নিয়ে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি। জরুরি বোর্ড মিটিং ডাকা হলেও সেখান থেকেও বের হয়নি স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নির্ধারিত সময় শেষ হলেও অনেক জেলা ও বিভাগ থেকে কাউন্সিলরদের নাম বিসিবিতে পৌঁছায়নি। এমনকি রাত ৯টার দিকে সাবেক বোর্ড প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদের ফরম জমা দেওয়া হয়। এই বিলম্বের কারণে বোর্ড মিটিংও পিছিয়ে দেওয়া হয়। বিসিবির পরিচালক ও মিডিয়া কমিটির প্রধান ইফতেখার রহমান সাংবাদিকদের জানান, তারা ৬টা ১১ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার মাধ্যমে জানতে পারেন সভাটি রাত ৯টায় অনুষ্ঠিত হবে। তবে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
এমন অস্পষ্টতা পুরো প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। নির্বাচনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনের জন্য শেষ মুহূর্তের এই বিশৃঙ্খলা ক্রীড়া মহলে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
সভাপতির চিঠি ও বিতর্ক
১৮ সেপ্টেম্বর বিসিবির সভাপতি আমিনুল ইসলাম জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলোর কাছে একটি চিঠি পাঠান। সেখানে বলা হয়, বিসিবির কাউন্সিলর হিসেবে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে নাম পাঠাতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা যথাযথভাবে মানা হয়নি। ফলে আগের ফরম বাতিল করে নতুন ফরম পাঠানো হয় এবং ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে তা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এই চিঠি নিয়েই তৈরি হয় বিতর্ক। অনেক জেলা ও বিভাগের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, এটি বিসিবির গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী। সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান কাউন্সিলর তামিম ইকবাল প্রকাশ্যে বলেন, “এই নোংরামিটা করা উচিত নয়। নির্বাচন হবে অবাধ—সুষ্ঠু, এখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না।”
তামিমের মতো প্রভাবশালী ক্রিকেটারের প্রকাশ্য মন্তব্যে বিষয়টি আরও গুরুত্ব পায়। ক্রিকেটপ্রেমীরাও মনে করেন, নির্বাচনে স্বচ্ছতা বজায় রাখার পরিবর্তে প্রশাসনিক কৌশলে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
আইনি জটিলতা ও আদালতের রায়
কাউন্সিলর মনোনয়ন প্রসঙ্গে ১৮ সেপ্টেম্বরের সভাপতির চিঠি নিয়ে আদালতে রিট করা হয়। রিটকারীরা যুক্তি দেন, বিসিবির গঠনতন্ত্রের ৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে কাউন্সিলর মনোনয়নের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই সভাপতির নির্দেশনা অবৈধ।
গত ২২ সেপ্টেম্বর দুপুরে হাইকোর্ট সভাপতির চিঠির কার্যকারিতা স্থগিত করেন। কিন্তু দেড় ঘণ্টার মধ্যেই আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত সেই আদেশ স্থগিত করে দেন। ফলে আপাতত নির্বাচনের তফসিল বহাল থাকে এবং আর কোনো আইনি বাধা থাকছে না।
এই আইনি টানাপোড়েন নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ক্রীড়া বিশ্লেষকরা বলছেন, আদালতে একের পর এক রিট এবং বিপরীতমুখী আদেশ পুরো প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।
ক্যাটাগরি বিভাজন ও ভোটার তালিকা
বিসিবির ভোটার তালিকা তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। ক্যাটাগরি—১: জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা। ক্যাটাগরি—২: বিভিন্ন ক্লাব। ক্যাটাগরি—৩: সার্ভিসেস গ্রুপ।
সভাপতির নির্দেশ অনুযায়ী, ক্যাটাগরি—১ থেকে শুধুমাত্র অ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে কাউন্সিলর মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু এটি নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। কারণ, অনেক জেলার স্থায়ী কমিটি বা নির্বাচিত কমিটি থাকলেও তাদের পাশ কাটিয়ে অ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে ক্যাটাগরি—২—এর বেশির ভাগ ক্লাব ইতিমধ্যেই কাউন্সিলরের নাম জমা দিয়েছে। ফলে তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রায় নিশ্চিত।
ক্যাটাগরি—৩ থেকে প্রার্থী হয়েছেন সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেবব্রত পাল। এ গ্রুপে পরিচালকদের ভোটের হিসাব—নিকাশ সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শেষ মুহূর্তে ক্যাটাগরি—১ ও ২ থেকে কারা টিকে থাকবেন, তা নিয়েই মূলত বাড়ছে অনিশ্চয়তা।
প্রভাবশালী মহলের ভূমিকায় প্রশ্ন
ক্রীড়া মহলের অভিযোগ, বিসিবির নির্বাচনে সব সময় কিছু প্রভাবশালী মহল সক্রিয় থাকে। তারা কাউন্সিলর মনোনয়ন থেকে শুরু করে ভোটার তালিকা পর্যন্ত নানা জায়গায় প্রভাব বিস্তার করেন। এবারের নির্বাচনেও সেই অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের অনেকেই আবারও নেতৃত্বে আসতে চান। এজন্য প্রক্রিয়াকে নিজেদের অনুকূলে রাখতে তারা চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে, ভিন্ন মতাদর্শী গোষ্ঠী বা নতুন প্রার্থীরা মনে করছেন, তাদের সুযোগ সীমিত করা হচ্ছে। ফলে নির্বাচন আগেভাগেই দ্বন্দ্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
স্বচ্ছতা ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। অনেকে মনে করছেন, কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না। ভোটার তালিকা প্রকাশে বিলম্ব, নিয়ম পরিবর্তন এবং কাউন্সিলর মনোনয়নে অস্পষ্টতা কমিশনের ওপর আস্থা কমাচ্ছে।
ক্রীড়া বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, যদি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না থাকে তবে তার প্রভাব মাঠের ক্রিকেটেও পড়বে। খেলোয়াড়দের মধ্যে বিভাজন তৈরি হতে পারে, প্রশাসনিক অস্থিরতা পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ক্রিকেট অঙ্গনের প্রতিক্রিয়া
সাবেক ক্রিকেটার ও কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশার সুর স্পষ্ট। কেউ কেউ বলছেন, বিসিবি বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রিকেট বোর্ডগুলোর একটি। অথচ এখানে নিয়ম—কানুনের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তামিম ইকবালের মতো সিনিয়র ক্রিকেটারের মন্তব্য প্রমাণ করে, ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ জমছে। অনেকেই প্রকাশ্যে না বললেও মনে করছেন, অবাধ—সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ভিন্ন নেতৃত্ব উঠে আসার সুযোগ রয়েছে। আর সেটাই হয়তো বাধা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
মাঠের ক্রিকেটে সম্ভাব্য প্রভাব
নির্বাচনের জটিলতা ও অনিশ্চয়তা শুধু প্রশাসনিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রভাব মাঠের ক্রিকেটেও পড়তে পারে। বোর্ড পরিচালনায় অস্থিরতা তৈরি হলে তা জাতীয় দলের পারফরম্যান্সেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। খেলোয়াড়দের চুক্তি, কোচ নিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়নসহ নানা ক্ষেত্রে বিলম্ব ঘটবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইসিসি বা এসিসি’র সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষাতেও নেতিবাচক বার্তা যাবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিসিবির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভবিষ্যতের সিরিজ আয়োজন ও বাণিজ্যিক আয়েও প্রভাব পড়তে পারে।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি
সব মিলিয়ে বলা যায়, বিসিবির নির্বাচনকে ঘিরে জটিলতা, বিতর্ক ও আইনি টানাপোড়েন ক্রমেই বাড়ছে। ক্রীড়া মহল, বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীরা চান একটি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
কারণ, ক্রিকেট এখন শুধু খেলা নয়— এটি বাংলাদেশের জাতীয় আবেগ, আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং অর্থনীতির বড় খাত। তাই এই খাতের নেতৃত্ব নিয়ে অব্যাহত অনিশ্চয়তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।