প্রায় ৪ কোটি লোকের বসবাস রাজধানী ঢাকায়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের গত এক বছরেও ঢাকা উত্তর এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সংস্কারের কোন ছোয়া লাগেনি। ঢাকা দুই সিটিতেই চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া দুই প্রশাসকের নেতৃত্ব চলছে প্রশাসনিক কার্যক্রম। দুই সিটিতেই জোড়া তালির মধ্য দিয়ে খুড়িযে খুড়িয়ে চলছে নাগরিক সেবাসহ কথিত উন্নয়নমূলক কার্যক্রম। মশক নিধনে কাঙ্খিতমানের সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী।
বর্তমান সরকারের আমলে অধিকাংশ মন্ত্রণালয়,দপ্তর, বিভাগ ও সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বেশকিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং ওইসব সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের র্দীঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতি, আইনী জটিলতা এবং নাগরিক সেবা সহজী করনে সংস্কারের কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, নির্বাচিত মেয়র এবং কাউন্সিলর না থাকায় প্রশাসন তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগছেন। দুই সিটিতেই রাস্তা ঘাটের বেহাল দশা। এসব বিষয়ে অনেকাংশ বিষয়েই জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটির স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, মশা মারার বিষয়টি তারা অনেক গুরুত্ব দিয়ে প্রতিদিন সকারে এবং বিকেলে মাঠে ময়দানে ওষুধ প্রয়োগ করছেন। তারা সরকারের বিভিন্ন বিভাগ এবং দপ্তারের সাথে সমন্বয় রেখে একদিকে মশক নিধনের পাশাপাশি মশা নিয়ে গবেষণার করছেন। তুলনামূলকভাবে য়াকা উত্তরে মশা কম বলে জানান ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুর ইসলাম বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্বেও নগরীতে মশক নিধন কার্যক্রম অনেক জোরদার করা হয়েছে। নগরীর প্রতিটি এলাকায় সীমিত জনবল নিয়ে সকালে এবং বিকেল মশক নিধন চলছে। একই সাথে জনসচেতনার কার্যক্রমও চলছে। এবছর ডেঙ্গুতে মুত্যুর সংখ্যা ঢাকার বাইরে বেশি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বৃষ্টির পানি দ্রুত নামাতে সংশ্লিষ্ট লোকজন কাজ করছে। অপরিকল্পিতভাবে নগরীর ড্রেনগুলোতে অনেক সময় পানি সরতে সময় লাগে। তবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মীরা বৃষ্টিতে ভিজেই ড্রেন পরিস্কার করছেন। এছাড়া নগরীর উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চলমান আছে। আন্দোলনকালে ৪৩ দিন নগর ভবন তালাবদ্ধ তাকলেও প্রশাসক এবং কর্মকর্তার মাঠে কাজ করেছেন। মন্ত্রণালয়ে এবং ঢাকা ওয়াসা ভবনে যথারীতি বৈঠক করেছেন। নগরীতে আঞ্চলিক কার্যলয় থেকে নাগরিক সেবা চালু ছিল। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বিলে কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উদঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দেখা যাক তদন্তে কি বেরিয়ে আসে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সূত্র মতে, ছাত্র জনতার গণআন্দোলনে গত বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্তাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিয়োগ পাওয়া প্রশাসকদের নানা দুর্বলতার সুযোগে জাতীয়তাবাদী শ্লোগানধারী কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী নেতা দাপট দেখিয়ে বদলি,পদোন্নতি, সুবিধাজন দপ্তরে পদায়নের মাধ্যমে ঢাকার দুই সিটিতেই একচেটিয়া সুযোগ নিচ্ছেন। তাদের অনেকই গত এক বছরে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন।
সূত্র মতে, বাজেটের অর্থ নানা কৌশলে কথিত উন্নয়ন মূলক প্রকল্প এবং কেনা কাটায় সিংহভাগ অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। যা পতীত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের লোপাটকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ এসবের যেন কোন জবাবদিতার বালাই নেই। অথচ আজ মশক নিধনসহ নাগরিক সেবার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। একটু ভারী বৃষ্টিতেই ঢাকার দুই সিটির অধিকাংশ এলাকার রাস্তা, গলিপথ ময়লা পানিতে তলিয়ে যায়। নগরবাসীর ভোগান্তির যেন শেষ নেই।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারী সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনে ঢাকা উত্তর সিটেতে গবেষণা সংশ্লিষ্ট এক এনজিও’র মালিক মোহাম্মদ মোহাম্মদ এজাজকে এক বছরের জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে সরকারের অতিরিক্ত সচিব মো. শাহজাহান মিয়াকে সময় উল্লেখ না করেই প্রশাসক নিয়োগ করা হয়।
নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএনসিসির একাধিক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, ঢাকা উত্তর সিটিতে প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণের পরই মোহাম্মদ এজাজ,গুলশান নগর ভবনে গড়েতোলেন একটি সিন্ডিকেট। প্রশাসক এজাজের ভাগ্নে লিটন, আত্মীয় মাহবুবুর রহমান, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. অরিফুর রহমান, প্রকৌশল বিভাগের কারো কয়েকজন কর্মকর্তা, রাজস্ব বিভাগের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা,সচিব, ক্রয় বিভাগ,আইটি বিভাগ,পরিবহন বিভাগ, সম্পত্তি বিভাগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের একাধিক কর্মকর্তা, ল্যান্ডফিলডের দায়িত্ব প্রাপ্ত পর্যায়ের জনৈক কর্মকর্তা এবং সমাজ কল্যান ও বস্তি উন্নয়ন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সিন্ডিকেট বেশ সক্রিয় হয়ে উঠে।
ইতোমধ্যে পতীত আওয়ামী সরকারের সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের দুর্নীতি, অনিয়ম, কোটি কোটি টাকার লোপাটের সিন্ডিকেটকে ছাড়িয়ে গেছে প্রশাসক এজাজের মামা ভাগ্নের সিন্ডিকেট। দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে একাধিক বার নগর ভবনে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু প্রশাসকের সিন্ডিকের অপকর্ম ও লোপাট কমছে না বরং আরো দাপটের সাথে লোপাটের জন্য নানা প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়ার প্রশাসন একটা নমনীয়। কারণ বিএনপির নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব দেয়ার নামে বিএনপির বহিরাগত লোকজন এবং সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা টানা ৪৩ দিন নগর ভবন তালাবদ্ধ করে রাখেন। নাগরিক সেবামূলক কার্যক্রম বন্ধ থাকে। অথচ ডিএসসিসির কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন ভাতা দিয়েছেন। কর্মকর্তাদের গাড়ির জ্বালানি তেল ও গ্যাস নিয়েছেন ড্রাইভাররা। কর্মকর্তাও জ্বালানির ভাউচারে সই করেছেন্ এই বিষয়ে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কোটি টাকার তেলচুরি বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পরে দুদক অভিযান চালিয়ে অনেক তথ্য উপাত্ব সংগ্রহ করেছে। তবে এই ঘটনায় প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এখন দেখা যাক প্রশাসকের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কি বেরিয়ে আসে।
নগর ভবনে ৬৫ তালা ঝুলিয়ে দিলেন ইশরাক সমর্থকরা
এরআগে ৪৩ দিন নগর ভবন তালাবদ্ধ করে রেখে প্রশাসনকে জিম্মি করা এবং নগরবাসীকে সেবা থেকে বঞ্চিত করার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে এখনো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি। এতে প্রমাণ হয়, প্রশাসকের সক্ষমতার অনেক ঘাটতির পাশাপাশি প্রশাসন পরিচালনায় তাদের দুর্বলা রয়েছে।
এছাড়া, মশক নিধন কার্যক্রম নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে। তবে সম্প্রতি মশক নিধন এবং ড্রেন, খাল পরিস্কারের অভিযান শুরুর খবর পাওয়া যায়। কিন্তু এসব কার্যক্রমের তেমন কোন সুফল পাচ্ছেন না ঢাকা দক্ষিণ সিটির বাসীন্দারা। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক কর্মচারীদের তিনটি গ্রুপ শুরু রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার নিয়ে অনেক বেশি তৎপর ও মনোযোগী। কিন্ত সে তুলনায় নগরবাসীর সেবায় তাদের মনোযোগ অনেক কম। মশা মারার কাজে তাদের তৎপরতা অনেক কম। রাস্তা ড্রেন,সংস্কার, উন্নয়ন এবং পরিস্কারের নামে শুধু কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। কাজের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে। ২২ সেপ্টেম্বর একটু ভারী বৃষ্টিতেই নগরীতে ময়লাপনিতে তলিয়ে গেছে অধিকাংশ এলাকা। অথচ কারোই যেন জবাব দিহিতার বালাইনেই।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা উত্তর সিটির আগার গাঁও এবং কল্যাণপুর এলাকার পুরনো খালের আর্রজনা পরিস্কারের কাজ চলছে
এদিকে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২২ সেপ্টেম্বর বৃষ্টিতে রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরা বিমানবন্দর এলাকা,খিলক্ষেত রেলগেট, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে কচুক্ষেত সড়ক, কাজীপাড়া- সেনপাড়া এবং রুপনগর সহ অনেক এলাকায় জলাবদ্ধায় দুর্ভোগের শিকার নগরবাসী।অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণে কদমতলীর পাটেরবাগ, কোদারবাজার এলাকার রাস্তা সেই বর্ষায় পানিতে তলিয়ে গেছে। শ্যামপুর, ডেমরাসহ ঢাকার অধিকাংশ সড়কের বেহাল অবস্থা। ঢাকার দুই সিটিতেই খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছেধীরগতিতে বড় আকারের পাইপ রাস্তার উপর ফেলে রেখে ব্যস্ত এ সড়কটিতে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়ে রাতদিন যানজট লেগেই থাকছে।
সূত্র মতে,চলতি বছর ঢাকার দুই সিটিসহ সারাদেশে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রাণহানি ঘটেছে। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছেন প্রায় ১৯০ জন। এর আগে ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু কখনও হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, এর আগে ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। সে বছর সর্বোচ্চ ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন আক্রান্ত এবং ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সম্প্রতি একদিনে ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
আবহাওয়া, মশা মারার পরিকল্পনা সব মিলিয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ কবে নাগাদ কমতে পারে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই কারও কাছে। নভেম্বর মাসে প্রকোপ কমে আসার কথা বলা হলেও প্রতিদিনই ৮০০-৯০০ রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। আর এর সঙ্গে মৃত্যু তো আছেই।
কীটতত্ত্ববিদ ড. জি এম সাইফুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মশা নির্মূলে কার্যকর কোনও পদ্ধতি নিয়ে আমরা কাজ করছি না। যখন রোগী বাড়ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন আমাদের কিছু কার্যক্রম দেখা যায় মশা মারার জন্য। কিন্তু মশা মারার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তা করা হচ্ছে না।