বাংলাদেশের বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক বর্তমানে দুর্নীতি, অপশাসন ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত শাসনের চরম দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যাংকের ভুক্তভোগী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ‘জুলাই বিপ্লব’এর পর সাধারণ কর্মচারীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হলেও, বাস্তবে ঘটেছে ঠিক তার বিপরীত। ব্যাংকের পুরনো দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেট নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় পাল্টে আবারো ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছে।
তারা অভিযোগ করেন, ‘বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক জাতীয়তাবাদী ফোরাম’ নামে একটি অস্বীকৃত ও অকার্যকর সংগঠনের ব্যানারে মো. জাহিদ হোসেন, ডিজিএমকে কেন্দ্র করে পুরাতন সিন্ডিকেটটি পুনরায় সংগঠিত হয়েছে।
এই ফোরামের নামে জাতীয়তাবাদী আদর্শের অপব্যবহার করে ব্যাংকের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, টেন্ডারসহ সব কার্যক্রমকে দুর্নীতির চক্রে পরিণত করা হয়েছে। কৃষি ব্যাংকের অননুমোদিত সিবিএ'র কমিটির ফয়েজ ও মিরাজ নিজেদেরকে যথাক্রমে সভাপতি ও সেক্রেটারি দাবি করছে যা সত্যিকার অর্থেই ভুয়া। শ্রম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এখনো সভাপতি এবং সেক্রেটারি হিসেবেই নাম দেখাচ্ছে প্রয়াত আব্দুল হালিম ও নাসিম হোসেন।
অভিযোগ উঠেছে, টাকা দিলে বদলি নিশ্চিত। আর এর প্রধান ভূমিকা পালন করছেন হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান ডিজিএম জাহিদ হোসেন। পদোন্নতি বানিজ্য সিন্ডিকেট টিমের মধ্যে রয়েছেন, ডিএমডি-২ খালেদুজ্জামান জুয়েল, আওয়ামী সরকারের সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধু ও বারংবার দুর্নীতির অভিযোগে গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়া কর্মকর্তা। উনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলমান। কৃষি ব্যাংকের ইতিহাসে যা নেই। তা করেছেন খালেদুজ্জামান জুয়েল।
তিনি ব্যাংকের ডিএমডি হওয়ার পরে একটি প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ টাকা স্পন্সর করেছেন। কৃষি ব্যাংক কখনোই কাউকে স্পসর হিসেবে টাকা দেয়নি। অথচো তিনি ডিএমডি হওয়ার পরে স্পন্সর দিয়েছেন। এই অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে খাওয়ার জন্য মূলত এই স্পন্সর দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ৫ লাখ টাকা ক্যাশ নেয়ার জন্য জন্য একজন ডিজিএমকে অনুরোধ করা হয়েছিলো। সেই টাকা ক্যাশ না দেয়াতে তাকে হেড অফিস থেকে বদলি করা হয়েছে।
আরেকজন সিন্ডিকেটে হোতা সৈয়দ লিয়াকত হোসেন, উপ-মহাব্যবস্থাপক, আন্তর্জাতিক বানিজ্য বিভাগ, প্রকা। সিবিএ বি-৯৮৫ এর অবৈধ উপদেষ্টা, সিবিএ কে পদোন্নতির জন্য ঘুষ বানিজ্যের ব্যপারে প্রধান পরামর্শদাতা মাস্টারমাইড এই দূর্নীতিগ্রস্ত নির্বাহী কর্মকর্তা। এদের সহযোগি সিবিএ সভাপতি ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক মো: মিরাজ হোসেন। এই সিন্ডিকেট সদস্যরা বদলির জন্য নিচ্ছেন বড় অঙ্কের টাকা। অভিযোগ অনুযায়ী, বিভাগের অভ্যন্তরে বদলির জন্য ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা, এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে বদলির জন্য ১.৫ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ গ্রহণ করা হচ্ছে। অথচ ব্যাংকের বদলি নীতিমালা ২০১৮-এর ১৮ ধারায় তিন বছরের বেশি একই কর্মস্থলে থাকা নিষিদ্ধ হলেও, এই সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় বহু কর্মকর্তা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে একই পদে বহাল রয়েছেন।
নামধারী সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা মামলাও। কৃষি ব্যাংকের সাবেক কর্মচারী সিবিএ’র নেতা আব্দুল হালিম (৬৩) মেরে হত্যা করে তারা। তিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত পিয়ন ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি ছিলেন। গত ১৮ ডিসেম্বর মাসে মতিঝিলে বিমান অফিসের সামনে তাকে পিঠিয়ে হত্যা করে। মতিঝিল থানায় তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। এই হত্যা মামলায় জামিনে রয়েছেন তারা।
সিন্ডিকেটের অপকর্মের কয়েকটি অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকে হাতে এসেছে। অডিও রেকর্ডের এক পাশে ছিলো সিবিএর পরিচয়দানকারী সভাপতি ফয়েজ আহমেদ অন্য পাশে হবিগঞ্জের জেলা শ্রমিক দলের সহ-সভাপতি মো. রফিকুল হায়দার সিদ্দিকী ওরফে সেলিম। বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন কারণে চাকরি চলে গেছে। তার চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার আলাপে। সিবিএ’র পরিচয়দানকারী সভাপতি ফয়েজ বলতে শোনা যাচ্ছে তার চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য টাকা দিতে হবে। প্রথমে ৫০০ টাকা একটা বান্ডিল দিতে হবে। এরপর সবাইকে নিয়ে বসে কাজ শুরু করবে বলে শোনা যাচ্ছে। সেখানে এই সিন্ডিকেটের নামই শোনা যাচ্ছে। সেখানে সবাইকে টাকা দিতে হবে। টাকা দিলেই কাজ হবে।
অডিও রেকর্ডে শোনা যাচ্ছে, সিবিএর পরিচয়দানকারী সাধারণ সম্পাদক মিরাজ হোসনের ১০ লাখ পাইয়ে দিয়েছেন এই সিন্ডিকেট। বিগত আমলে বিভিন্ন অপরাধে মিরাজের চাকুরি চলে গিয়েছিল। ৫ আগস্টের পর সেটা জোর করে এমডিকে দিয়ে নিয়মের বাহিরে চাকুরি বহাল করে বেতন ভাতাসহ এই টাকা ব্যাংক থেকে নিয়েছে বকেয়া হিসেবে বে রেকর্ডে শুনতে পাওয়া যায়।
বরখাস্ত পরিদর্শক মোঃ রফিকুল হায়দার সিদ্দিকী ওরফে সেলিম অডিও রেকর্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ রেকর্ড আলাপচারিতা তাদের। তার চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে ঘুষ চেয়েছিলেন সিবিএর পরিচয়দানকারী সভাপতি ফয়েজ আহমেদ।
ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, এই সিন্ডিকেটকে পুরোপুরিভাবে সহযোগিতা করছেন বর্তমান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্চিয়া বিন্তে আলী। এই সিন্ডিকেট যা বলে তাই তিনি শুনেন। তাদের সকল অপকর্ম জেনেও তাদের ব্যাপারে কোনো কথা বলছেন না তিনি।
টেন্ডার বাণিজ্য: নিম্নমানের পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কাজ পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে, প্রতি মাসে গোপনে ‘কমিশন’ যাচ্ছে সিন্ডিকেট প্রধানদের কাছে। এতে ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতিতো হচ্ছেই, পাশাপাশি সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
সূত্রে জানা গেছে, পদোন্নতিতে অর্থের প্রভাব, মেধার মূল্য নেই: ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও মেধার পরিবর্তে ঘুষকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এক কর্মকর্তা জানান,‘পদোন্নতির জন্য এখন মেধা নয়, টাকাই আসল মাপকাঠি।’ প্রমাণ হিসেবে বলা হয়, ২০২৪ সালে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে মুখ্য কর্মকর্তার পদে ৪৬৮২ থেকে ৫০২৭ পর্যন্ত তালিকায় থাকা ২৫৬ জনকে বাদ দিয়ে ৫০২৮ থেকে ৫০৭৯ পর্যন্ত তালিকায় থাকা ৩৬ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়, যা স্বাভাবিক নয় এবং এর পেছনে অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি। এই সিন্ডিকেটের মূল নেতৃত্বে রয়েছেন ডিএমডি-২ খালেদুজ্জামান, সৈয়দ লিয়াকত হোসেনসহ এই সিন্ডিকেট।
ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি, এই সিন্ডিকেট অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ও বহিরাগতদের ব্যবহার করে ক্যাডার বাহিনী গঠন করেছে। যারা সময়-অসময়ে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে হুমকি, গালাগাল ও এমনকি মারধর করতেও পিছপা হচ্ছে না। ফলে সাধারণ কর্মচারীরা আতঙ্কিত, অনেকেই চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। ভুক্তভোগীরা এই দুর্নীতির অবসানে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তারা জানান, এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শিগগিরই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করবেন এবং এ বিষয়ে গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। তাদের ভাষ্য,‘বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংককে বাঁচাতে হলে সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। আমরা সরকারের কাছে সুষ্ঠু তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থার দাবি জানাই।’
বিভিন্ন অভিযোগ ব্যাপারে কৃষি ব্যাংকের সিবিএর পরিচয়দানকারী সভাপতি ফয়েজ আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো খুব ‘সেনসিটিভ’ বিষয়। এগুলো ফোনে বলা যাবে না। সরাসরি কথা বলতে হবে। তাই তিনি সরাসরি অফিসে যোগযোগ করতে বলেন।
হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান ডিজিএম জাহিদ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো গুজব ও মিথ্যা বানোয়াট। এগুলো একটি গ্রুপ ছড়াচ্ছে। বদলিতে কোনো প্রকার ঘুষ বাণিজ্য হয় না।
এ ব্যাপারে উপ-ব্যবস্থাপক পরিচালক খালেদুজ্জামান জুয়েল বলেন, এগুলো গুজব ও মিথ্যা বানোয়াট। এগুলোর কোনো কিছুই সত্যতা নেই।
এ ব্যাপারে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্চিয়া বিন্তে আলীকে ফোন করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।