বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫,
২৯ কার্তিক ১৪৩২
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
বিশেষ সংবাদ
আয়নাঘর থেকে ফিরে আসা এক যুবকের উপাখ্যান
জীবন ফিরে পেয়েছি হারিয়েছি দিশা
নিজস্ব প্রতিবেদক
Publish: Saturday, 23 August, 2025, 8:40 PM  (ভিজিট : 210)

জানালা নেই। দরজার লৌহ কপাটও বন্ধ। নেই  আলো-বাতাস। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, আকাশ-বাতাস কিছুই নেই সে দুনিয়ায়।  বাইরের কোন শব্দও নেই। কি দিন! কি রাত! সব একাকার। যেন কবরে জীবন্ত এক বাসিন্দা আমি।

 সে কী জীবন বলে বোঝানোর ভাষাও নেই আমার। আয়না ঘর থেকে মুক্তি পাওয়া সুজন নামে এক যুবক কমলাপুরের আজকের দৈনিক কার্যালয়ে এসে সম্প্রতি এক সাক্ষাতে মর্মস্পর্শী কথাগুলি বলছিলেন। পত্রিকার ডিজিটাল ভার্সনে ফেসবুক ও ইউটিউবে তার বক্তব্য আজ প্রকাশিত হল। তার 

আয়না ঘরের জীবনের ভগ্নাংশ তুলে ধরা হল-
সুজন বলছিলেন-দু:সহ সেই যন্ত্রণা  বলে বোঝানোর যদি কোন ভাষা থাকতো, তাহলে বলতাম। এখন কি আর বলব? কাকেই বা কি বলি! কে ফিরিয়ে দিবে আমার হারানো জীবনের সাড়ে পাঁচটি বছর ? আমি বেঁচে আছি এটা সত্য। এজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। কিন্তু ওরা আমাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। আমার জীবন-যৌবন, অর্থ-বিত্ত, ব্যবসা-বাণিজ্য এক কথায় বেঁচে থাকার স্পৃহা শেষ করে দিয়েছে। হারিয়ে ফেলেছি জীবন চলার দিশা। 

এই পৃথিবী এখন আমার কাছে যেন ছায়া-মায়া। ঘুরছি বিচারের আশায়। জীবিকার তাগিদে। এখনো আমার কাছে এই দুনিয়াটা আয়না ঘরই মনে হয়। সেই দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে ফেরে। যেখানে যাই সেখানেই যেন আয়না ঘরের এক প্রতিচ্ছবি। তবুও যতটুকু মনে পড়ে ততটুকু বলার চেষ্টা করছিÑ‘আমি মোহাম্মদ আলী খান সুজন। পিতা মরহুম মুজাফফর আলী খান। ঢাকার উত্তর শাহজাহানপুরে আমার বাসা। সেদিন ছিল ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল। বৃহস্পতিবার। বয়স ৪২ বছর। কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলাম। ৬ জন লোক কালো রঙের একটি নোয়া গাড়িতে এসে আমার গতিরোধ করে। কথা আছে বলে তারা টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে ওঠায়।

 গাড়িতে ওঠার সাথে সাথেই আমার হাতে লাগিয়ে দেয় হাতকড়া। চোখ বেঁধে ফেলে কালো কাপড়ে। কোন রকম কথা বললেই গুলি। শুনে আমার পিলে চমকে যায়। গাড়িটি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার সময়  জিজ্ঞাসাবাদ কালে তারা নিজেদের ডিজিএফআইয়ের লোক বলে পরিচয় দেয়। এর আধা ঘন্টা পরে চোখ বাঁধা অবস্থায় অন্য একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে । আরেকটি জায়গায় নিয়ে নামানো হয়। সেখানে বন্দি করা হয় একটি রুমে। সেখান থেকে পৃথিবীর আর কিছু বোঝার কোন উপায় নেই।

 এর মধ্যে আটকে গেল আমার জীবন। তৃতীয় দিনে সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসে আমার পরিচয় সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্ন করেন। আমার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেন। সপ্তম দিনে আমাকে ডিজিএফআইয়ের প্রধান অফিসে নেয়া হয়। সেখানে মেজর জেনারেল (অব.) তারেক আহমেদ সিদ্দিকী অর্থাৎ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টার পক্ষ থেকে কথা বলার জন্য মেজর জেনারেল সাঈদ মাসুদ সাহেবের সামনে হাজির করা হয়। আমার সেনা কর্মকর্তা এক ভাই এবং তার স্ত্রী কন্যাদের বিরুদ্ধে প্রেস ব্রিফিং দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। আমার ভাই সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা । তার বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট না দিলে আমাকে ছাড়া হবেনা বলে জানিয়ে দেয়। আমি রাজি হইনি।

সেই অপরাধে সেখানে দশ মাসের বেশি সময় আটক রাখা হয়। আটককালে নির্যাতনের নির্মম বর্ণনা আমি এখন আর দিতে পারছিনা। সে কথা মনে করলেও আমার শরীর অবশ হয়ে আসে। আমার হাড়ে-হাড়ে সে নির্যাতনের চিহ্ন বিদ্যমান । আমি বুঝি আর কোনদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবো না। মানসিক নির্যাতন, শারীরিক অত্যাচার, ইলেকট্রনিক ডিভাইস এমন কিছু নেই যা দিয়ে আমার উপর নির্যাতন করা হয়নি। আমি জানতাম আমার সামরিক কর্মকর্তা ভাই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতেই দেশ ছেড়ে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছেন। তারেক সিদ্দিকীর সাথে তার বিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জের ধরে আমার ভাই দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন।

 তিনি লন্ডনে বসবাস করেন। সেখানে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে জীবন-যাপন করছেন। কিন্তু আমি ধরা পড়ে যাই আয়না ঘরের তাবেদারদের হাতে। আমি জানি আমার ভাইয়ের অনেক সম্পত্তি আয়না ঘরের এই তাবেদাররা লুটপাট করে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তারেক সিদ্দিকীর নির্দেশে এসব কিছু সংগঠিত হয়েছে। ১৯১৯ সালের ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর আমার ভাইয়ের পিএস আতিকুল আলী, অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত খোরশেদ আলম, অফিসের জেনারেল ম্যানেজার অনারারী ক্যাপ্টেন (অব.) জুহুরুল হককে ডিজিএফআইয়ের লোকজন ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তাদের অবস্থা কার কি হয় তা আমার বিস্তারিত জানা নেই। ১০ মাস ২০ দিন পরে ২০২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে আমাকে অন্যত্র এক অন্ধকার প্রকষ্ঠে পাঠানো হয়। আমি জানতে পারি আমার পাশের রুমে এডভোকেট আশরাফ আলী সাহেব আটক আছেন। ওই আয়না ঘরে ৪৬ মাস ১৩ দিন আটক রাখা হয়।

২০২৪ সালের গণঅভুত্থানের পর  ৫ আগস্ট দিবাগত ভোর রাতে পূর্বাচলের শেষ প্রান্তে চোখ বেঁধে ওরা ফেলে যায় আমাকে। অতি কষ্টে সেখান থেকে আমি আমার ভাইয়ের বাসায় ফিরি। আমি ‘সুজন অ্যাপারেল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ২০০৯ সাল থেকে গার্মেন্টস্রে ব্যবসা করি। অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকার একটি ঋণ ছিল। জমি বিক্রি করে দুই কোটি ৯৫ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করি। বাকি ৬১ লাখ টাকা পরিশোধের প্রক্রিয়া চলছিল। এ অবস্থায় এই ঘটনা ঘটে। এছাড়া প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের পান্থপথ শাখায় মোহাম্মদ এন্টারপ্রাইজের নামে একটি ঋণ ছিল। হযরতপুর মৌজায় আমার প্রায় ৬০ শতাংশ সম্পত্তি বন্ধক রাখি। ওই ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়াও চলছিল। আমার অবর্তমানে সব তছনছ হয়ে গেছে।

পাঁচ বছর তিন মাস ১৩ দিনের বিচার বহির্ভূতভাবে তারেক সিদ্দিকীর হুকুম ও নির্দেশে আমাকে আটক করে ওই ব্যাংকের টাকার বিপরীতে দেওয়া চেক এর মামলায় সাজা প্রদান করা হয়।  বর্তমানে আমি শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আর্থিকভাবে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তা কেটে ওঠার মত সাধ্য আমার নেই। বিশেষ করে আমার বোন মিলি আমাকে দেখাশোনা করতেন। তিনি আমার গুমের কারণে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে আজ জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে। এখনো তিনি হাসপাতালের বাসিন্দা। আমার বোন আমার জীবনের এই দুর্দশায় নিজের জীবনকে বিপন্ন করে দিয়েছেন। তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেননি।

আল্লাহর কাছে আবারও শুকরিয়া আদায় করিÑআমার বাবা-মা এ দৃশ্য চোখে দেখেননি। তার আগেই তারা পরপারের বাসিন্দা হয়েছেন। আমার পক্ষ থেকে গুম কমিশনে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আমার আর অবশিষ্ট কিছু নেই। এ অবস্থায় বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী সরকারের এই অত্যাচার-অবিচারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমার পাশে দাঁড়ালে কিছুটা হলেও মানসিক শক্তি পাব। আর্থিকভাবেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবো বলে আশা করছি । গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এই সরকার, এই দেশ, এই সমাজের ওপর আমি গভীর আস্থাশীল। হারিয়ে যাওয়া জীবনটিকে আমি শুধু একটি দুর্ঘটনা ভাবতে চাই। সে সঙ্গে কামনা করি আমার জীবনের এই পরিণতি দেশের কোন নাগরিককে যেন কোন দিনই বরণ করতে না হয়।

আ.দৈ/আরএস


   বিষয়:  আয়নাঘর   থেকে   ফিরে   আসা   এক   যুবকের   উপাখ্যান  
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

বিএনপি মহাসচিব সঙ্গে ফ্রান্সের নতুন রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ
ইভ্যালির রাসেল-নাসরিনের ৫ বছরের কারাদণ্ড
সেনাবাহিনী-বিজিবি-পুলিশের অবস্থান ট্রাইব্যুনালে
প্রধান উপদেষ্টা সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদ
১৭ নভেম্বর হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের মামলার রায়
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

ফরিদপুরে গ্রেফতার হওয়া আ'লীগ নেতা ফারুক কারাগারে
ডিএনসিসি প্রশাসকের দপ্তরের নাম ভাঙ্গিয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি আরিফ; সম্পাদক উবাইদা
রাজধানীতে ফায়ার সার্ভিসের গেটের পাশে বাসে অগ্নিকাণ্ড
ফরিদপুরে জেলা আ.লীগের সভাপতি ফারুক হোসেন আটক
বিশেষ সংবাদ- এর আরো খবর
close
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান

ব্যবস্থাপনা সম্পাদকঃ মাসুদ আলম
প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik$gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝