ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের আমলে জাতীয় নির্বাচনে রাষ্ট্রদ্রোহ ও দিনের ভোট আগের রাতেই সম্পন্ন করা এবং ভয়াবহ জালিয়াতি ফলাফল কারচুপির সুনিদিষ্ট অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার দায়ের হওয়া মামলায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে ফের চারদিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত।
আজ শুক্রবার (২৭ জুন) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আওলাদ হোসাইন মুহাম্মদ জোনাইদের আদালত এই রিমান্ডের আদেশ দেন। এর আগে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার অভিযুক্ত সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদেও জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। একই সাথে আসামি কে এম নূরুল হুদার পক্ষে তার আইনজীবী মো. ওবায়দুল ইসলাম রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন।
পরে রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। আদালত উভয় পক্ষেয় পক্ষের আবেদনের ওপর শুনানি গ্রহণ শেষে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৪দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গত ২২ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরে নূরুল হুদার বাড়িতে গিয়ে ‘স্থানীয় জনতা’ তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।
এরআগে প্রভাব খাটিয়ে প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় প্রথম দফায় সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদার বিরুদ্ধে ৪দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার সিএমএম আদালত।
ওই রিমান্ড শেষে গতকাল তাকে আদাল হাজির কওে পুনরায় ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে,আদালত ৪দিনের রিমান্ড মঝ্হুর করেন। সাবেক সচিব নূরুল হুদা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দেশের দ্বাদশ সিইসি। তার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের সব ভোট হয়।
মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকারের আমলে টানা ৩টি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রহসনের। জালিয়াতি, দিনের ভোট রাতেই সম্পন্ন করা, ফলাফল কারচুপির এসব নির্বাচনের অভিযোগে সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ, কে এম নূরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে বিএনপি। দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং মামলা, গুম, খুন ও তথ্য সংরক্ষণ সমন্বয়ক সালাহ উদ্দিন খান বাদী হয়ে গত ২২ জুন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা এ মামলা করেন।
এ মামলায় গত ২২ জুন উত্তরা থেকে নূরুল হুদাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পরদিন ২৩ জুন নূরুল হুদার চারদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর গত ২৫ জুন রাজধানীর মগবাজার থেকে হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেফতার করে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পরদিন ২৬ জুন কাজী হাবিবুল আওয়ালের তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
এ মামলায় প্রথমে দণ্ডবিধি আইনের সাতটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়। পরে এর সাথে আরও তিনটি ধারা যুক্ত করা হয়। এসব ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহ, অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতারণা ও নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে দণ্ডবিধির ১২৪ (ক) ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে সাবেক নির্বাচন কমিশনাররাসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে।
এ ধারায় সর্বনিম্ন ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে তাদের। এছাড়াও মামলাটিতে দণ্ডবিধি আইনের ৪০৬ ধারায় বর্ণিত অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ আনা হয় হয়েছে। এ ধারায় সর্বোচ্চ ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। মামলায় দণ্ডবিধির ৪২০ ধারাটিও যুক্ত করা হয়েছে। প্রতারণার সংক্রান্ত এ ধারাটির অভিযোগ মামলার বিচারে প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ৭ বছরের সাজা হতে পারে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনারদের।
আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ধারাগুলোর মধ্যে ১৭১(খ) ধারায় নির্বাচনী অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেনের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। ১৭১(ঘ) ধারায় বর্ণিত জালভোট প্রদান ও এতে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে নির্বাচন আসামিদের বিরুদ্ধে।পরে আরও ১২৪ (ক), ৪০৬ ও ৪২০ ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে ১২৪ (ক) ধারাটিতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ১৭১(ছ) ধারায় বর্ণিত নির্বাচন সম্পর্কে মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে।
এ ধারাটিতে বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নির্বাচনের ফল প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত চরিত্র বা আচরণ সম্পর্কে সত্য ঘটনা বলে এমন কোনো বিবৃতি দান বা বিবরণ প্রকাশ করে যা মিথ্যা এবং যা সে মিথ্যা বলে জানে বা বিশ্বাস করে কিংবা সত্য বলে বিশ্বাস করে না, তবে সেই ব্যক্তি অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।” নির্বাচন সম্পর্কে মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ার এ ধারায় শুধু অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
মামলাটিতে দণ্ডবিধির ১৭১(জ) ধারায় বর্ণিত নির্বাচনে অবৈধ অর্থ প্রদানের অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে। এ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা জরিমানা হতে পারে নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য আসামিদের। দণ্ডবিধির ১৭১(ঝ) ধারায় বর্ণিত নির্বাচনী হিসাব না রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। বিচারে এ ধারার অভিযোগ প্রমাণিত হলে নির্বাচনে কারচুপিতে জড়িত আসামিদের সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা জরিমানা করা হতে পারে। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি আইনে নির্বাচন সংক্রান্ত জালিয়াতির ১৭১ ধারায় এসব অভিযোগ আনা হয়েছে।
এছাড়াও এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি আইনের ১২০(খ) ধারায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেই বিধিতে বলা হয়েছে, “কেউ যদি দুই বছরের অধিক বা যাবজ্জীবন কিংবা মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি পাওয়ার মতো কোনো অপরাধ করে, আর এই অপরাধ সংঘটনের জন্য কেউ যদি পরিকল্পিতভাবে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করে, তাহলে সে ব্যক্তিও সমান সাজা পেতে পারেন।”
এছাড়া ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের তৎকালীন সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ, নির্বাচন কমিশনার মো. আবদুল মোবারক, আবু হানিফ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাবেদ আলী, শাহ নেওয়াজ ও তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সচিবসহ প্রধান নির্বাচন কমিশন অফিসের অন্য কর্মকর্তা। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন সিইসি এ কে এম নূরুল হুদা, নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার শাহাদাত হোসেন চৌধুরীকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগে একই সময়ে দায়িত্ব পালন করা তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী, তৎকালীন ঢাকা মহানগরের পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক প্রধান (অজ্ঞাত), জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক প্রধান (অজ্ঞাত) এবং পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ নুরুল আলমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে মামলায় আসামিদের তালিকায় ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল, নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীব, আলমগীর হোসেন, আনিছুর রহমানসহ তৎকালীন নির্বাচন সচিবেরও নাম আছে।
আ. দৈ./কাশেম