ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ন এবং প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে। ডিএনসিসিতে এই সিন্ডিটের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এবং লোপাটের ঘটনায় প্রতিবাদ করলেই নানা হুমকি আসে। এসব বিষয় নিয়ে প্রশাসকের সিন্ডিকেটর বিরুদ্ধে চলছে প্রচন্ড ক্ষোভ, অসন্তোষ । কারণ এই সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপত্তি প্রদানসহ প্রতিবাদকারী সাহসি, দক্ষ কর্মকর্তাদের পক্ষে স্বস্থিতে দাঁয়িত্ব পালন করা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ছে।
প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের সিন্ডিচের সাথে বেআইনী কর্মকান্ডে নিয়ে দ্বিমত পোষণ করায় *ইতোমধ্যে ডিএনসিসির বেশ কয়জন শীর্ষ স্থানীয় পর্যায়ের বিসিএস প্রশাসনের কর্মকর্তাকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, অবশেষে গতকাল সোমবার (২৬ মে) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামানকে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়েছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি ডিএনসিসির সিইও’র দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
কামরুজ্জামান মাত্র ৩ মাস আট দিনের মাথায় ডিএনসিসির এই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ১৬ এপ্রিল একই দিনে পৃথক দুটি আদেশে ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। একই সাথে মো. নুরুজ্জামানকে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক এবং মো. মনিরুজ্জামানকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়।
সংশ্লিণ্ট সূত্র মতে, গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের সঙ্গে সিইও কামরুজ্জামানের করপোরেশনের বিভিন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে মতানৈক্য চলছিল। একমাত্র স্থায়ী হাট গাবতলী পশুর হাটের ইজারা দেওয়া নিয়েও প্রশাসকের সঙ্গে তৎকালীন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মতবিরোধ তৈরি হয়। এরপর হঠাৎ প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামানকে বদলি করা হয়।
আরো অভিযোগ রয়েছে, এরআগে আদালতে মামলা থাকা সত্বেও গোপন আতাতের মাধ্যমে অবৈধভাবে বানানীতে হোটেল শেরাটনের হোল্ডিং টাক্স নিধিারণ নিয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেন প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। এই বিষয়টি নিয়ে কর্মকর্তাদের সাথে প্রচন্ড বিরোধে জড়িয়ে পড়েন প্রশাসক।
প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানের সাথে প্রশাসকের দ্বন্দ্ব হয়েছিল মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের জায়গায় অবৈধভাবে তৈরি হওয়া মার্কেট ভবন উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া নিয়ে। গৃহকর (হোল্ডিং ট্যাক্স) স্বয়ংক্রিয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েও বিরোধিতা করেছিলেন প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এসব কারণে প্রশাসকের সঙ্গে ডিএনসিসির বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বে থাকা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। প্রশাসকের প্রতি কর্মকর্তাদের অসন্তোষও তৈরি হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে দাপ্তরিক কার্যক্রমে। সর্বশেষ সিইও কামরুজ্জামানের হঠাৎ বদলিতে এর প্রভাব আরও প্রকট হতে পারে। কারণ ডিএনসিসিতে প্রশাসকের সিন্ডিকেট নিয়ে ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে।
যে সব অভিযোগ বেশি আলোচিত হচ্ছে,গাবতলী হাট ইজারার দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রধান ছিলেন সিইও কামরুজ্জামান। তিনিসহ মূল্যায়ন কমিটিতে থাকা ডিএনসিসির পাঁচটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং নিরীক্ষা কর্মকর্তা মিলে গত ৭ এপ্রিল সভা করে গাবতলী হাটের সর্বোচ্চ দরদাতা মেসার্স আরাত মোটরকে ইজারা দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। তবে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেওয়ার পরিবর্তে প্রশাসক খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত দেন। কারণ হিসেবে তখন প্রশাসক এজাজ প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, ইজারার দরপত্রপ্রক্রিয়ায় ভুল ছিল।
গত ৩০ এপ্রিল গাবতলী হাটের ইজারা নিয়ে ‘সর্বোচ্চ দরদাতা ইজারা পাননি, গাবতলী হাটে খাস আদায় করছেন “পছন্দের” ব্যক্তিরা’ শিরোনামে প্রথম আলোর অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, গাবতলী হাটের দরপত্রপ্রক্রিয়ায় প্রশাসকের পছন্দের ব্যক্তি সর্বোচ্চ দরদাতা হতে পারেননি। তাই তিনি দরপত্র আহ্বানে প্রক্রিয়াগত ভুল দেখিয়ে ইজারার পরিবর্তে খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। বাস্তবে খাস আদায়ের নামে ওই হাট থেকে হাসিল আদায় করছেন প্রশাসকের পছন্দের দরদাতা ও তাঁর লোকজন।
অবশ্য বদলি ও প্রশাসকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান। গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি সরকারের একজন আজ্ঞাবহ কর্মচারী। সরকার যেখানে আমাকে পদায়ন করবে, আমি সেখানে যেতে বাধ্য। সিটি করপোরেশন ভালো চলুক, এটাই আমি চাই।’ এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না বলেও জানান।
প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের নিয়োগ ও দায়িত্ব পালন নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। ২০ মে এজাজের অপসারণের দাবিতে গুলশান-২–এ ঢাকা উত্তর সিটির নগর ভবনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করেছেন গণ অধিকার পরিষদের নেতা–কর্মীরা। সেদিনের কর্মসূচি থেকে মোহাম্মদ এজাজকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ ও গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছিল গণ অধিকার পরিষদ।
গত এপ্রিলে সাবেক প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান ও সাবেক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানকে হঠাৎ বদলি করার পেছনেও প্রশাসকের সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি কাজ করেছে বলে মনে করছেন ডিএনসিসির কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, প্রশাসকের সঙ্গে তৎকালীন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তার গাবতলীর হাটের ইজারা দেওয়া নিয়েই দ্বন্দ্ব হয়েছিল। আর প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার দ্বন্দ্ব হয়েছিল মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের জায়গায় অবৈধভাবে তৈরি হওয়া মার্কেট ভবন উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া নিয়ে। পাশাপাশি গৃহকর (হোল্ডিং ট্যাক্স) স্বয়ংক্রিয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েও বিরোধিতা করেছিলেন ওই কর্মকর্তা।
আ. দৈ. /কাশেম