বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক খাত, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ও শেয়ারবাজার এবং বিনিয়োগ ও ঋণের স্তম্ভই এখন মারাত্মক বিপর্যস্ত। খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্র, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি এবং বাজারে জাঙ্ক কোম্পানির আধিপত্য সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে। রাজধানীর অস্থিরতা ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে আরও অনিশ্চিতার দিকে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেকটাই স্থবিরতা মধ্যে রয়েছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানির সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতার পাশাপাশি এই স্থবিরতার বড় কারণ ঋণের উচ্চ সুদহার। এতে পুরনো ব্যবসার সম্প্রসারণ যেমন থমকে গেছে, তেমনি নতুন বিনিয়োগ ঠেকেছে তলানিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, জুন মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ দশমিক শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসিক তথ্যে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে- চলতি বছরের মে মাসে ছিল ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ, এপ্রিলে সাড়ে শতাংশ, মার্চে ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ, জানুয়ারিতে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ, আর গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ ।
ব্যাংকের উচ্চ সুদহারও বেসরকারি ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা। বর্তমানে ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ সুদে। আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশের ওপর থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণেই ঋণের সুদহার বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, সদ্যোবিদায়ি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে। গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ ৯১ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে (জুলাই-এপ্রিল) ছিল ১২৭ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ১৪১ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৬০ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। তার আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছিল ১৭১ কোটি ডলার। করোনার সময়ে ২০২০-২১ অর্থবছরেও বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ১৩২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিনিয়োগ এসেছিল ১২০ কোটি ডলার। করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিনিয়োগ এসেছিল ৩৪৮ কোটি ডলার। গত ১৪ বছরের মধ্যে বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগ সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরেও দেশে ১২০ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। এরপর আর কোনো অর্থবছরে এর চেয়ে কম বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। আর এবার সেটা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের বেসরকারি খাতের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। ব্যাংক ঋণই ব্যবসায়ীদের প্রধান ভরসা। কিন্তু সেখানে সুদহার বেশি। বিকল্প অর্থায়নের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজারের অবস্থাও ভালো না।
ব্যাংকাররা বলছেন, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগ বা ব্যবসা সম্প্রসারণে না যাওয়ায় বড় অঙ্কের ব্যাংক ঋণ বিতরণ হচ্ছে না। এ কারণে কারখানা স্থাপনের মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও আর্থিক অস্থিরতাকে দায়ী করেছেন বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি উদ্বেগজনক হারে কমেছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি খুবই এলার্মিং সিচুয়েশন দেখেছে। বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্মুথ অপারেশন নিশ্চিত করার জন্য শিল্পের সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি প্রয়োজন। এ ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ-উৎপাদন, ব্যবসা পরিচালনা এবং স্মুথ সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা ধরে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
ডিসিসিআই আয়োজিত বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পর্যালোচনায় তিনি বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের হার ডাবল ডিজিটে উন্নীতকরণ, মন্দ ঋণ কমাতে নজরদারি বাড়ানো, আর্থিক খাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা আনয়ন এবং ঋণের সুদহার হ্রাস একান্ত অপরিহার্য।’
খেলাপির দুষ্টচক্রে বন্দি ব্যাংক খাত
দীর্ঘদিনের শিথিল নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির কারণে দেশের ব্যাংক খাত খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গেলো জুন মাসের শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা। এর বাইরেও ব্যালেন্স শিটে লুকিয়ে থাকা আরও ৩ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ প্রকাশের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি, অবলোপনকৃত ৮০ হাজার কোটি এবং আদালতের স্থগিতাদেশে আটকে থাকা ৬০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সেন্ট্রাল ক্রেডিট ব্যুরো (সিআইবি) হালনাগাদ করলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ লাখ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।
খেলাপিতে এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের দেশ।’’ ২০২৪ সালে দেশের মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ২ শতাংশ খেলাপি হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। এডিবির ভাষায়, বাংলাদেশ এশিয়ার “সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার” দেশ। বিপরীতে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সংস্কারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমাতে সক্ষম হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “নিয়ম যত কঠোর হচ্ছে, খেলাপি ঋণের অঙ্ক তত বাড়ছে। ভারতের মতো সাহসী সংস্কার ছাড়া এ সংকট কাটবে না।”
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ এবং বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী না হলে সমস্যার সমাধান হবে না।’’
৫ ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করে বাঁচানোর চেষ্টা
খেলাপি ঋণে ডুবতে থাকা পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক ফার্স্ট সিকিউরিটি, সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন এবং এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করে একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নতুন ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’। সরকার এর জন্য অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার মূলধন জোগান দেবে। এই ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৪৮ থেকে ৯৮ শতাংশের মধ্যে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেও সংকট
ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় কার্যত ভাটা পড়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে বকেয়া ছিল প্রায় ৩১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে মাত্র ২১৯ কোটি টাকা।তবে ইতিবাচক দিকও আছে। জুলাই মাসে ব্যাংক আমানতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশে, যা আগের মাসের তুলনায় সামান্য উন্নতি। ব্যাংকাররা এটিকে আস্থা ফেরার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।
দেউলিয়ার পথে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো
ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। এখানে খেলাপি ঋণের হার আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০টি সমস্যাগ্রস্ত এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণ ২১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা, যা ঋণপোর্টফোলিওর ৮৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই খাত কার্যত দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারায় এনবিএফআই খাতের প্রতি আস্থা ভেঙে পড়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ২০ প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ছিল ২৫,৮০৮ কোটি টাকা, কিন্তু জামানত ছিল মাত্র ৬,৮৯৯ কোটি টাকা— অর্থাৎ মোট ঋণের মাত্র ২৬ শতাংশই সুরক্ষিত।
শেয়ারবাজার: আস্থাহীন বিনিয়োগকারীরা
অর্থনীতির তৃতীয় স্তম্ভ শেয়ারবাজারেও দীর্ঘদিন ধরে দুর্বলতা বিরাজ করছে। দেশের শেয়ারবাজার গত ১৬ বছরে প্রায় ৩৮ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে বিনিয়োগকারীরা প্রতিবছর গড়ে ৩ শতাংশ হারে মূলধন হারিয়েছেন। বিপরীতে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী বাজারকে ব্যবহার করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত ৩৯৭ কোম্পানির মধ্যে ৯৮টির শেয়ার এখন ফেস ভ্যালু ১০ টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে। এর অর্ধেকের বেশি শেয়ারের দাম ৫ টাকারও কম। এর মধ্যে রয়েছে ৩৩টি ব্যাংক ও এনবিএফআই, ৩৫টি মিউচুয়াল ফান্ড এবং ১৭টি টেক্সটাইল কোম্পানি।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘কলকারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে। তিনি আরো বলেন, ‘অর্থনীতির সার্বিক অবস্থার এখনো উন্নতি না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কম। তাঁরা ওয়েট অ্যান্ড সি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।’ তা ছাড়া ব্যাংকের ঋণের সুদহার বেশি হওয়ায় ব্যবসা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘বর্তমানে দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে, যার ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। যাঁরা নতুন শিল্প স্থাপন বা ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছেন, তাঁরাও একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করছেন।’
বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, ‘যত দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বৈধ সরকার গঠিত হবে, তত দ্রুত দেশের অর্থনৈতিক গতি ফিরে আসবে, বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।’