পৃথিবীর মানচিত্রে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও স্বাধীন ভূখণ্ডের দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনি জনগণ। অস্ত্রের ভাষায়, কিংবা কূটনৈতিক লড়াইয়ের মাধ্যমে, সেই সংগ্রাম এখনো চলমান।
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো তিনটি প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশের ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া নিঃসন্দেহে এই দীর্ঘ লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অর্জন।
তবে প্রশ্ন উঠছে—এই স্বীকৃতি কি কেবল প্রতীকী? নাকি এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক নতুন বাস্তবতার সূচনা?
ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় কাঠামো আজও পূর্ণাঙ্গ নয়—নেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্ত, নেই নির্ধারিত রাজধানী বা নিজস্ব প্রতিরক্ষা বাহিনী। তবু জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে প্রায় তিন—চতুর্থাংশ ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
জাতিসংঘে ‘স্থায়ী পর্যবেক্ষক’ মর্যাদায় অংশ নিলেও, ভোটাধিকার নেই। অলিম্পিকে অংশ নেয় ফিলিস্তিনি অ্যাথলেটরাও। এসবই দেখায়—আংশিক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকলেও, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা থেকে ফিলিস্তিন এখনো দূরে। তিন দেশের এই স্বীকৃতি সময়োপযোগী ও কৌশলগত। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো যুক্তরাজ্যের অবস্থান—কারণ, এটি প্রথম জি—৭ দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিল।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, “এটি দ্বি—রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে একটি স্পষ্ট বার্তা।” গাজায় মানবিক বিপর্যয় এবং পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণের কারণে যুক্তরাজ্যের উদ্বেগ বেড়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এরপর কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার পদক্ষেপ একত্রে পশ্চিমা রাজনীতিতে নতুন এক বার্তা পাঠিয়েছে—ইসরায়েলের প্রতি ‘নিঃশর্ত সমর্থন’—এর নীতি ধীরে ধীরে ভাঙছে।
এমন এক সময় এই স্বীকৃতি এল, যখন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে ফিলিস্তিনপন্থী প্রস্তাব একের পর এক ভেটো করছে এবং গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ওয়াশিংটনের অবস্থান ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
ইসরায়েল এই স্বীকৃতিকে ‘হামাসের পুরস্কার’ বলে আখ্যা দিয়েছে। তাদের ভাষায়, “এটি ৭ অক্টোবরের হামলার বৈধতা দেওয়ার সামিল।” জবাবে যুক্তরাজ্য বলেছে—এই স্বীকৃতি কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়, বরং ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। তবে ইসরায়েল ইতোমধ্যেই পশ্চিম তীরে নতুন বসতি নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু করেছে, যা অনেক বিশ্লেষকের মতে, স্বীকৃতির বিরুদ্ধে কৌশলগত জবাব।
রামাল্লায় এই স্বীকৃতিকে ঘিরে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলেছেন, “এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করল।” আবার অনেকেই বলছেন, “এটা দেরিতে এলেও অমূল্য নয়।” তবে একটা বড় অংশের আশঙ্কা—“ইসরায়েল হয়তো আরও কঠোর হয়ে উঠবে, দমন—পীড়ন বাড়াবে।” অর্থাৎ, এই স্বীকৃতি আশা যেমন জাগায়, তেমনি বাস্তব বাস্তবতায় পৌঁছাতে কতটা দীর্ঘ পথ বাকি তা মনে করিয়ে দেয়।
রাষ্ট্রের স্বপ্ন, এখনো অনেক দূর: যতদিন না ফিলিস্তিন জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ পায়, যতদিন না তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডের সীমান্ত ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং যতদিন না ইসরায়েল আধিপত্যবাদী নীতি থেকে সরে আসে— ততদিন এই স্বীকৃতি মূলত প্রতীকী বলেই বিবেচিত হবে।
তবে ইতিহাস বলে, অনেক সময় প্রতীকই আন্দোলনের গতি বদলে দেয়। তাই এই স্বীকৃতি এক অর্থে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র গঠনের পথে রাজনৈতিক শক্তি ও কূটনৈতিক সহায়তা যোগ করল—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এই স্বীকৃতি হয়তো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের চূড়ান্ত পদক্ষেপ নয়, কিন্তু এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়—পশ্চিমা বিশ্বেও পরিবর্তনের বাতাস বইতে শুরু করেছে। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে হয়তো একদিন ফিলিস্তিন ‘প্রতীকী রাষ্ট্র’ নয়, বরং একটি বাস্তব, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে বিশ্ব মানচিত্রে।
আ.দৈ/ওফা