বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫,
২৯ কার্তিক ১৪৩২
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
আন্তর্জাতিক
সিএনএন এক্সক্লুসিভ গণহত্যার অভিযোগপীড়িত
মিয়ানমারেই গোপনে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাল ভারত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
Publish: Sunday, 14 September, 2025, 7:35 PM  (ভিজিট : 95)

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একাধিক বক্তৃতায় রোহিঙ্গাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে উল্লেখ করে। রোহিঙ্গারা যখন বুঝতে পারে যে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তখন তারা ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। একজন তরুণ তার আত্মীয়কে ফোন করে বলেন, ‘আমরা একটি দ্বীপে আছি... চারপাশেই শুধু সমুদ্র... দয়া করে সবাইকে বলুন। যেকোনো মুহূর্তে সেনাবাহিনী আমাদের গ্রেফতার করতে পারে।‘

যে দেশটিকে নিরাপদ আশ্রয় ভেবছিলেন, সে দেশেই জীবনের সবচেয়ে কঠিন আঘাত পেলেন মোহাম্মদ ইসমাইল। তার ২০ বছর বয়সী মেয়ে আসমাকে ৮ বছর আগে মিয়ানমারের গণহত্যা থেকে বাঁচিয়ে ভারতে নিয়ে এসেছিলেন ইসমাইল। সেই আসমাকেই ভারত সরকার গোপনে ফেরত পাঠিয়েছে সেই দেশে, যেখানে তাদের সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করা হয়।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগের শিকার হয়ে লাখ লাখ মানুষ প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এদের মধ্যে ইসমাইল ও তার মেয়ে আসমা ভারতে আশ্রয় নেন। দিল্লিতে তারা নিজেদের জন্য একটি নতুন জীবন তৈরি করেছিলেন। ইসমাইল বস্তা কুড়ানোর কাজ করতেন। অন্যদিকে পড়াশোনা করতেন আসমা। গত মে মাসে আসমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।

কিন্তু বিয়ের মাত্র কয়েক দিন আগে, আসমা এবং তার সঙ্গে থাকা আরো ৩৯ জন রোহিঙ্গাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নতুন পরিচয়পত্র তৈরির জন্য বায়োমেট্রিক তথ্য দেয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তারা নিখোঁজ ছিলেন। তিন দিন পর ধার করা একটি ফোন থেকে আসা কয়েকটি ফোন কল জানায়, কী ঘটেছে তাদের ভাগ্যে। তাদের তোলা হয়েছিল একটি বিমানে, এরপর নিয়ে যাওয়া হয় নৌকায় করে। এক সময় সশস্ত্র লোকেরা তাদের চোখে কাপড় বেঁধে ভারত মহাসাগরে ফেলে দেয়। তাদের বলা হয়, ‘যাও, কাছের যে কোনো তীরে উঠে পড়ো।‘

সেই তীরটি ছিল মিয়ানমার যেখানে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ এনেছিল জাতিগত নির্মূলের অভিযোগ আর যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায়, চালানো হয়েছিল গণহত্যা। সিএনএনের একটি অনুসন্ধানে ভারত, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের তথ্য, সে সঙ্গে ফ্লাইট ও শিপিং ডেটার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভারত সরকার গোপনে ওই ১৩ জন নারী ও ২৭ জন পুরুষকে কোনো ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়াই নির্বাসিত করেছে। আর এটি ভারতীয় আইনেরও পরিপন্থী।

সিএনএন একাধিক ভারতীয় সরকারি দপ্তর ও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো প্রতিক্রিয়া পায়নি। আসমা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে চার মাস পেরিয়ে গেলেও মোহাম্মদ ইসমাইল তার কোনো খবর পাননি। এই দুঃস্বপ্ন শুরু হয়েছিল ৬ মে সন্ধ্যায়, যখন পুলিশ দিল্লিতে ইসমাইলের বাড়িতে আসে। তাদের কাছে কিছু রোহিঙ্গার নাম ছিল, যাদের বায়োমেট্রিক তথ্যের জন্য স্থানীয় থানায় আসতে বলা হয়েছিল। সেই তালিকায় আসমা এবং তার খালার নামও ছিল।

পরদিন ভোরে ইসমাইলকে ফোন করে আসমা জানান যে, তাদের আটক করা হয়েছে। এরপর সকাল ১১টার দিকে তিনি আবারও ফোন করে জানান, তাদের সবাইকে একই ধরনের পোশাক পরতে বলা হয়েছে। একই দিনে আটক হওয়া আরেক রোহিঙ্গা, জন আনোয়ারও এই ঘটনা নিশ্চিত করেছেন। তিনি মিয়ানমারে পৌঁছানোর পর ফোন কলের মাধ্যমে তার ভাইকে এ ঘটনার বিবরণ দেন। সেই অডিও ক্লিপ আছে সিএনএন-এর কাছে।

আনোয়ার তার ভাইকে জানান, বায়োমেট্রিক নেয়ার পর তাদের ‘স্বাস্থ্য পরীক্ষা”র জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদের নেয়া হয় একটি বিমানবন্দরে। সেই দিনের ফ্লাইটের সময় প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ছিল। আনোয়ার জানান, অবতরণের পর তিনি ‘পোর্ট ব্লেয়ার’ লেখা একটি সাইনবোর্ড দেখতে পান। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের এই প্রধান শহরটি দিল্লি থেকে প্রায় ১,৫০০ মাইল দূরে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত।

সিএনএনের বিশ্লেষণ করা ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা দেখায় একটি এয়ারবাস এ৩২১-২১১ যাত্রীবাহী বিমান ৭ মে দুপুর ২:২০ মিনিটে দিল্লির বাইরে গাজিয়াবাদ বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে। বিমানটির ট্রান্সমিটার আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ৫০ মাইল দূরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এর প্রায় ৫০ মিনিট পর আবার তা চালু হয়। বিমানটি ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা পরিচালনা করে।

আনোয়ার জানান, বিমান থেকে নামার পর তাদের একটি ‘বড় সাদা জাহাজে’ তোলা হয়। সেই জাহাজে তাদের চোখ বেঁধে ফেলা হয় এবং বন্দুকধারী লোকজন শুরু করে নানা ধরনের হুমকি। একজন অফিসার বলেন, তোমাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। তোমাদের কোনো দেশ নেই। আমরা যদি তোমাদের মেরেও ফেলি, কেউ কিছু বলবে না। কয়েক ঘণ্টা পর, তাদের দুটি ছোট নৌকায় ভাগ করে মাঝসমুদ্রে নামিয়ে দেয়া হয়। আনোয়ার বলেন, একটি গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে তাদের বলা হয় সাঁতরে পাড়ে উঠতে।

অন্যান্য অডিও রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গারা যখন বুঝতে পারে যে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তখন তারা ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। একজন তরুণ তার আত্মীয়কে ফোন করে বলেন, ‘আমরা একটি দ্বীপে আছি... চারপাশেই শুধু সমুদ্র... দয়া করে সবাইকে বলুন। যেকোনো মুহূর্তে সেনাবাহিনী আমাদের গ্রেফতার করতে পারে।‘

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর মতে, ভারতে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। অনেকের কাছে ইউএনএইচসিআর-এর শরণার্থী পরিচয়পত্র আছে। তবে ভারত সরকার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। এ কনভেনশন শরণার্থীদের ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়ার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়।

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একাধিক বক্তৃতায় রোহিঙ্গাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে উল্লেখ করে তাদের বিতাড়িত করার অঙ্গীকার করেছেন। মে মাসে তার মন্ত্রণালয় অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশী নাগরিকদের যাচাই করার জন্য কর্মকর্তাদের ৩০ দিনের সময়সীমা দেয়।

দিল্লির পুলিশ কর্মকর্তা কাওয়ালজিৎ সিং সিএনএনকে নিশ্চিত করেছেন যে, ৬ মে ৪০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তিনি এটিকে বৈধ বলে দাবি করলেও বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি। কারণ, এটি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়।

জাতিসংঘের মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক টম অ্যান্ড্রুস এই ঘটনাকে ‘জঘন্য’ এবং আন্তর্জাতিক আইনের ‘গুরুতর লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছেন। মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো ৪০ জন রোহিঙ্গার সঠিক অবস্থান এখনো জানা যায়নি। এক স্থানীয় বাসিন্দা সিএনএনকে জানান, গত ৯ মে দক্ষিণাঞ্চলীয় তেনিনথারি অঞ্চলের তীরে রোহিঙ্গাদের আনা হয়েছিল। রোহিঙ্গারা জানান, তারা আড়াই দিন ধরে কিছু খাননি।

তারা স্থানীয় একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছে আশ্রয় পায়। মিয়ানমারের ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক উপমন্ত্রী এবং একমাত্র রোহিঙ্গা সদস্য অং কিয়াও মো সিএনএনকে নিশ্চিত করেছেন যে, ৯ মে ওই ৪০ জন রোহিঙ্গা ভারত থেকে এসেছে এবং তাদের একটি সামরিক গোষ্ঠী সহায়তা করছে।

সেই ৪০ জনের দলে ছিলেন ডেভিড শরীফের পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য। শরীফ সিএনএনকে বলেন, ‘আমরা চিন্তা সবচেয়ে বেশি, কারণ আমরা ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। মিয়ানমারে আমরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত।‘দিল্লি থেকে এক হাজার মাইলেরও বেশি দূরে মোহাম্মদ ইসমাইল তার মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। তার মেয়ে এখন মিয়ানমারে, যেখানে গণহত্যার শিকার হয়েছিল রোহিঙ্গারা। দ্বিতীয়বারের মেয়েকে ভয়াবহতা থেকে বাঁচানোর ব্যাপারে পুরোপুরি অসহায় এক পিতা এই ইসমাইল।

আ.দৈ/আরএস


আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

হিরো আলমকে আটক করতে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
সেনা কর্মকর্তা সেজে প্রেমের জাল বুনলেন প্রতারক
দেশ ছেড়ে পালিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী আওয়ামী লীগ: এটিএম আজহারুল
হাসিনার সাক্ষাৎকার নিয়ে ঢাকায় ভারতীয় দূত তলব
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরি সরঞ্জাম সহ আটক ৩
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

ফরিদপুরে গ্রেফতার হওয়া আ'লীগ নেতা ফারুক কারাগারে
ডিএনসিসি প্রশাসকের দপ্তরের নাম ভাঙ্গিয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি আরিফ; সম্পাদক উবাইদা
রাজধানীতে ফায়ার সার্ভিসের গেটের পাশে বাসে অগ্নিকাণ্ড
ফরিদপুরে জেলা আ.লীগের সভাপতি ফারুক হোসেন আটক
আন্তর্জাতিক- এর আরো খবর
close
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান

ব্যবস্থাপনা সম্পাদকঃ মাসুদ আলম
প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik$gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝