রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫,
৬ মাঘ ১৪৩১
ই-পেপার

রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫
অর্থ-বাণিজ্য
সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধনের দুর্নীতির সাধনা
নিজস্ব প্রতিবেদক
Publish: Wednesday, 2 October, 2024, 9:09 PM  (ভিজিট : 150)

শেখ হাসিনার নেতৃত্ত্বাধীন সরকারের সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ মজুমদারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে কাড়ি কাড়ি টাকা অর্জনের বিষয়টি বেশ আলোচনায় উঠে এসেছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে পাঁচ বছরের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন নওগাঁর ধান ব্যবসায়ী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবাও ছিলেন ধানের ব্যবসায়ী। ধান-চালের ওই আড়তের ব্যবসা দিয়েই চলেছে নয় ভাইবোনের বড় সংসার। সেই সাধন চন্দ্র শেখ হাসিনার ছাতায় ভর করে মন্ত্রিত্ব নিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন। যিনি নিজেও কখনো কল্পনা করেননি কোনো দিন মন্ত্রী হবেন।

 সাধন চন্দ্রের সাড়ে পাঁচ বছরের মন্ত্রিত্বকালে ঘুষ, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নে হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদের হাট বসিয়েছেন তাঁর পুরো পরিবারে। সেই দুর্দান্ত দুর্নীতির বরপুত্র মন্ত্রী সাধন চন্দ্র সরকার পতনের পর এখন লাপাত্তা। এখন তার বদনসীব চলছে। নওগাঁর নিয়ামতপুর হাজীনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে নসিব তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর মহাদায়িত্বে। টানা চারবার এমপি হয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, গত সাড়ে ১৫ বছর সাধন চন্দ্রের জনপ্রতিনিধির জমানা ছিল নৈরাজ্য ও অরাজকতায় ভরা। ক্ষমতাকে তিনি মনে করতেন ‘জাদুর কাঠি’। সেই জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় নানা অপকর্মে জড়িয়ে নিজের ভাতিজা রাজেশ মজুমদার, ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা, ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদার এবং দুই জামাতা আবু নাসের বেগ ও নাসিম আহম্মেদকে নিয়ে গড়ে তোলেন দুর্নীতির এক দুর্ভেদ্য সিন্ডিকেট। টাকার বিনিময়ে সব ‘অসাধ্য সাধন’ হতো মন্ত্রী সাধন চন্দ্রের আস্তানায়। শুধু তাই নয় তার পেটে ছিল খাদ্য বিভাগও। 

১৮ কোটি মানুষের এ দেশে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের রয়েছে খাদ্য মজুদ ও জোগানের এক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। যেখানে খাদ্য বিভাগের প্রতিটি পদ অত্যন্ত লোভনীয়। প্রতিটি পদায়নে অন্তত ৩০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ কোটি টাকা পর্যন্ত নিলাম উঠত মন্ত্রীর আস্তানায়। লোভনীয় পদের মধ্যে ছিল আরসি ফুড (রিজিওনাল কন্ট্রোলার অব ফুড), ডিসি ফুড (ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার) এবং ওসি এলএসডি (গুদাম কর্মকর্তা)। এ ছাড়া ধান-চাল বেশি উৎপাদন হয় এমন তালিকাভুক্ত জেলার বাইরেও যে কোনো স্থান ও পদে পদায়নের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতে হতো সাধন সিন্ডিকেটকে। খাদ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন এসব তথ্য।

ঘুষ, দুর্নীতির সব অপকর্ম সমন্বয় করতেন মন্ত্রীর ভাতিজা রাজেশ মজুমদার। তিনি ছিলেন খাদ্যমন্ত্রীর সহকারী; বসতেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ে। সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রীর একান্ত সচিব সাধন চন্দ্রের বড় জামাতা আবু নাসের বেগ (মাগুরার সাবেক ডিসি) ও মন্ত্রীর এপিএসের দায়িত্বে থাকা ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদার। টাকার বিনিময়ে দপ্তরের যে কোনো পদায়ন, বদলি, বরাদ্দ-সবকিছু মন্ত্রণালয়ে বসে তাঁরাই সামলাতেন। টাকার লেনদেন হতো মন্ত্রীর বেইলি রোডের সরকারি বাসায়। সেই বাসভবন সন্ধ্যা থেকেই খাদ্য বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার পদভারে মুখর থাকত। প্রায় প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে দরদাম ঠিক করে পছন্দমাফিক বদলি কিংবা পদায়ন নিতেন খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।

 তার ভাইদের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে হাতিয়েছেন শত কোটি টাকা। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেই প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন। এর সঙ্গে সরকারি সব দপ্তরের নির্মাণ কাজের ২০ শতাংশ কমিশন চালু করে ছিলেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ও খাদ্য নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। খাদ্যমন্ত্রী হলেও নওগাঁ জেলায় সড়ক, এলজিইডি, কৃষি, খাসপুকুর, সরকারি জমি ও বিভিন্ন নিয়োগ বাণিজ্য ছিল তাঁর দখলে।

 পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নওগাঁয় গড়ে তোলেন মজুমদার সাম্রাজ্য। যার প্রতিটি ধাপে ছিল অনিয়ম, দুর্নীতি ও দখল বাণিজ্য। সরকারি সব দপ্তরের নির্মাণ কাজের ২০ শতাংশ কমিশন সিন্ডিকেট চালু করেছিলেন। যে কোনো কাজ শুরু হলেই সাবেক মন্ত্রী সাধন চন্দ্রকে ২০ শতাংশ দিতে হতো। তাঁর ইশারা ছাড়া কোনো অফিস চলতো না। তিনি এক পৃথক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। সিন্ডিকেট গড়ে নওগাঁ-১ আসনের সাবেক এমপি সাধন চন্দ্র মজুমদার মাফিয়া হয়ে ওঠেন। 

এলাকায় পুকুর লিজ, জমি দখল, সরকারি কাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি প্রকল্প, সরকারি কেনাকাটা, বরাদ্দ সবই নিয়ন্ত্রণ করতেন এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা। সিন্ডিকেটের প্রধান ছিলেন সাধন মজুমদারের ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা। সঙ্গে ছিলেন ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদার ও বড় মেয়ের জামাতা আবু নাসের বেগ। এমপি নির্বাচিত হয়েই ধীরে ধীরে সবকিছু দখলে নেন সাধন। ২০১৯ সালে মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। গত ৪ আগস্ট পর্যন্ত নওগাঁ জেলায় ছিল এক নাম-সাধন চন্দ্র মজুমদার।

 এ ছাড়া উদ্বোধন, উদ্যাপন, পালিত, গঠিত সব অনুষ্ঠানেই তাঁর নাম রাখা চাই। না থাকলেই বরং বিপত্তি হতো সংশ্লিষ্টদের। সরকারি নির্মাণ কাজ, রাস্তাঘাট উন্নয়ন, নিয়োগ সংক্রান্ত, স্কুল ম্যানেজিং কমিটি, ধর্মীয় উপাসনালয়, খাসজমি ও জমি দখল, বিচার সালিশ, বাজারব্যবস্থা, বিশেষ দিবস, নিজ দলের নেতৃত্ব গঠনসহ সবখানেই অনুমোদন লাগত খাদ্যমন্ত্রী সাধনের। নওগাঁ জেলাকে নিজের আয়ত্তে নিতে যা দরকার সবকিছুই তিনি করেছিলেন। মন্ত্রী হয়ে বড় বড় সরকারি কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেসব কাজের লাভের সিংহভাগই যেত মন্ত্রীর পকেটে। ফলে বঞ্চিত হচ্ছিলেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। এ নিয়ে দলের ভিতরেও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু পদ হারানোর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি।

আরো অভিযোগ উঠেছে, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ক্ষমতায় থাকাকালে বড় বড় মিলাররা গোডাউনে হাজার হাজার টন পুরনো চাল ও ধান মজুত করে রাখতেন। তাঁদের সিন্ডিকেটের কারণেই চালের বাজারে কখনই অস্থিরতা কাটেনি। এসব করে তারা সে সময় শত শত কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন।

গম ও চালসহ খাদ্যপণ্য আমদানীতে রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন সাবেক মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। পছন্দের লোক দিয়ে গোপনে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ছাপানোসহ নিজস্ব লোককে সেই টেন্ডার পাইয়ে দিতেন। সরকারিভাবে সংগ্রহের চাইতে বিদেশ থেকে আমদানীতেই বেশি আগ্রহ ছিল তার। এসব কর্মকান্ডে তাকে সহযোগিতা করতো সোহেল নামে এক ঠিকাদার। গম সোহেল নামেই যার পরিচিতি গোটা খাদ্য বিভাগে। এভাবেই হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। 

খাদ্য বিভাগের বাইরে নওগাঁ জেলা সদরের বিভিন্ন অফিস ও কর্মকতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের দপ্তরের সব কাজেই অনুমোদন লাগতো সাধন চন্দ্র মজুমদারের। এটা না করলে তার ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার নানাভাবে হেনস্থা করতেন।  পোরশা, নিয়ামতপুর ও সাপাহার উপজেলা সদরের বেশ কয়েকজন জানান, সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা হলেও তিনি থাকতেন শহরে। তার ভাই ও সিন্ডিকেট সদস্যরা পুরো জেলাজুড়ে রাজত্ব চালাতো। জেলার খাদ্য বিভাগের সকল কিছু নিয়ন্ত্রন করতো তারা। সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকা নিজেরদের পকেটে নিতো সাবেক মন্ত্রীসহ তার বাহিনী।  

আ. দৈ. /কাশেম
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

থানায় বসে এসআইয়ের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও ভাইরাল
‘ঋণখেলাপিরা যাতে বিএনপির মনোনয়ন না পায় সে চেষ্টা করব’
কক্সবাজারের হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টী পরিমল শর্মার সংবর্ধনা
ফরিদপুরে শহীদ জিয়ার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা
বাংলাদেশে বায়ু দুষণের বছরে ১,০২,৪৫৬ জনের মৃত্যু
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

ফরিদপুরে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতারা গন সংযোগে ব্যস্ত
দুদকের মামলায় বিএফআইইউয়ের মাসুদ বিশ্বাস গ্রেপ্তার
চায়না পোশাকে সয়লাব দেশ
ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেন যারা
ডিবি হারুনকে নিয়ে বিস্ফোরক তথ্য দিলেন ডা. সাবরিনা
অর্থ-বাণিজ্য- এর আরো খবর
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মাসুদ আলম

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : [email protected]
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝