দেশের ৭টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) নিয়মিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক অথবা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়াই চলছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশেরই এসব শীর্ষ পদ বছরেও বেশি সময় ধরে খালি, যা আইনের লঙ্ঘন। একাধিকবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও এমডি পাচ্ছেন না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক কেলেঙ্কারি, অনিয়ম ও তারল্য সংকটে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে সচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে কেউ সাহস করে দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না। বিদায় এদের এমডি পাওয়া দুষ্কর হয়েছে পড়েছে।
যেসব প্রতিষ্ঠানে এমডি নেই, এফএএস ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানী লিমিটেড, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেড, ফার্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড, আভিভা ফাইন্যান্স লিমিটেড, প্রাইম ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড।
বর্তমানে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভারপ্রাপ্ত এমডি বা সিইও হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছেন। তাদের কেউ কেউ দুই বছরের বেশি সময় ধরে এমন দায়িত্ব পালন করছেন।
ফিন্যান্স কোম্পানি অ্যাক্ট ২০২৩ অনুসারে, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান শীর্ষ পদ টানা তিন মাসের বেশি খালি রাখতে পারবে না। এর মধ্যে পদটি পূরণ করা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো প্রশাসক নিয়োগ করেনি।
এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন,‘আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ভালো এমডি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে শিগগিরই যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এমডি নেই, সেখানে এমডি নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে।’
আলোচিত সমালোচিত পিকে হালদার ও তার ঘনিষ্ঠদের শিকার এফএএস ফাইন্যান্স। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে কমপক্ষে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। সেই চার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এখন চরম খারাপ। একটি বিলুপ্তের পথে, বাকি তিনটিও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। নানা কৌশল করে এসব প্রতিষ্ঠান দখল করেন পি কে হালদার। প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন, শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়েছেন। এমনকি দেশের বাইরেও কোম্পানি খোলেন।
তারা অনিয়মের মাধ্যমে অন্তত চারটি ব্যাংক বহির্ভূত প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন ক্যাপিটাল'র সুনাম থাকলেও এরপর থেকে সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। মেয়াদ পূর্ণ হলেও আমানত ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১ সালে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের আমানতের ১০০ কোটি টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ইউনিয়ন ক্যাপিটাল সংবাদ শিরোনাম হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের অনুপাত ছিল ৪৩ দশমিক ১২ শতাংশ। ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ডিএমডি এএনএম গোলাম সাব্বির ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও অনুমোদন দিয়েছে।
২০২১ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এফএএস ফাইন্যান্সের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে। বর্তমানে এর স্পন্সর বা শেয়ারহোল্ডার পরিচালক নেই। গত ছয় মাস ধরে প্রতিষ্ঠানটির ডিএমডি এএফ সাব্বির আহমেদ এর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। এফএএস ফাইন্যান্সের খেলাপির পরিমাণ এক হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। এটি এর বিতরণ করা ঋণের ৯০ শতাংশ।
জিএসপি ফাইন্যান্সের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জিল্লুর রহিম চৌধুরী প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করছেন। কোম্পানিটির খেলাপি ঋণ ৯২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আভিভা'র খেলাপি ঋণ এক হাজার ৯০২ কোটি টাকা বা ৭১ দশমিক দুই শতাংশ। প্রায় ৮৯ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়া ফার্স্ট ফাইন্যান্সের সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মাকসুমুল মাহমুদ এখন প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে আছেন।
দেশে ৩৫টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত সেপ্টেম্বর শেষে এ খাতের মোট খেলাপির পরিমাণ ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এটি বিতরণ করা ঋণের রেকর্ড ৩০ শতাংশ। সাত প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের অনুপাত ৮০ শতাংশের বেশি।
ফারইস্ট ফাইন্যান্সের এমডি মোহাম্মদ আলী জারইয়াব বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে নামে-বেনামে ঋণ রয়েছে। যা আদায় করা কঠিন। তাই এই কঠিন কাজ সহজে কেউ কাঁধে নিতে চাচ্ছে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ হওয়ায় সিইওর কাজ করা কঠিন। এসব প্রতিষ্ঠান আর্থিক অবস্থা ফিরে পেতে লড়াই করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কী রকম ঝুঁকিতে আছে তা বোঝার জন্য যোগ্য ব্যক্তিকে ভালো বেতনের প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে না।’ ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি হিসেবে নিয়োগের জন্য অভিজ্ঞ ব্যক্তি খুঁজে বের করতে প্যানেল গঠনের কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আ. দৈ. /কাশেম/ রমজান